একবিংশ শতাব্দীতে ধর্মীয় কুসংস্কার দিয়ে সমাজ নিয়ন্ত্রণ কতোটা প্রাসঙ্গিক?

প্রকাশিত:সোমবার, ১৬ এপ্রি ২০১৮ ০২:০৪

একবিংশ শতাব্দীতে ধর্মীয় কুসংস্কার দিয়ে সমাজ নিয়ন্ত্রণ কতোটা প্রাসঙ্গিক?

সাদিক তাজিন:

বলা হয় ধর্ম পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে এসেছে। জাতি, সম্প্রদায়, গোত্র ইত্যাদির মধ্যে সম্পর্কের সেতুবন্ধনই ধর্মের কাজ। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার যুগে যখন বিজ্ঞানের জয়জয়কার তখন এই সময়ে এসে আমরা কি দেখতে পাই? আমরা দেখি ধর্মই যত বিভাজনের মূল। জাতিতে জাতিতে, গোত্রে গোত্রে এমনকি রাস্ট্রে রাস্ট্রে পর্যন্ত দ্বন্ধ, বিভাজন, ঘৃণার বিজ বপণ করে বিচ্ছিন্নতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর মানুষ তার মানবিক মন ও মননের পাশ কেটে পুণ্যের আশায় মানবতার বদলে ধর্মের দ্বারা নিজেদের বিভক্ত করছে। ধর্ম স্রেফ একটি বিশ্বাস হওয়ার পরও ধর্মকে সমাজ ওও রাস্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সমাজ ও রাস্ট্রকে বিষাক্ত করে তুলছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এসব পশ্চাদগামীতা যেখানে চিন্তা করাও দূরুহ হওয়ার কথা ছিল সেখানে আজ বাংলাদেশ এসবের শিকার।

এদের মধ্যে আবার অধিকাংশই তাদের ধর্মের ফান্ডামেন্টের বাইরে গিয়ে অতিউৎসাহি ধার্মিক হতে গিয়ে সামাজিক অশান্তির কারন হয়। তারা নিজেরা ধর্মকে ভুল জানে। আবার কখনো তারা তাদের অনুসারীদের ভুল জানায় দূর্বিসন্ধিমূলক। আলচ্য নিবন্ধে আমি ইসলাম ধর্মের সেরকম কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করব-

ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআনের অধিকাংশ আয়াতই প্রতীকী। অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে নানান ঘটনা ও করনীয় নির্ধারনে, শ্রষ্টার ক্ষমতা, প্রজ্ঞা ও জ্ঞান বুঝাতে ইঙ্গিতের পাশাপাশি উপমার, আবার কখনে কখনো উদাহরনের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এজন্য হাদিসের মাধ্যমে পরবর্তীতে সেগুলো মানুষের কাছে ক্লিয়ার করা হয়েছে। না হলে মানুষ বুঝতেই পারতো না কেন এবং কোন প্রেক্ষিতে কথিত আয়াতটি এসেছে। অথচ আমরা দেখি বেশিরভাগ মানুষই এর গভীরতায় না গিয়ে আক্ষরিক অর্থকে গ্রহণ করে বসে থাকে যা সম্পুর্ণ অযৌক্তিক। এমন অনেক আয়াত আছে যেগুলো বুদ্ধিমান পাঠকের কাছে স্পষ্ট হওয়ার কথা। যেমন : সুরা ফাতেহর দশম আয়াতে বর্ণিত ‘আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপরে’ অর্থাৎএটাই বুঝাচ্ছে আল্লাহর ক্ষমতা অনেক বেশি। সুরা ফুরকানের ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘তারপর তিনি (আল্লাহ) আরশে সমাসীন

হন।’ আরশ শব্দের অর্থ রাজসিংহাসন। যেহেতু আল্লাহর কােন দেহ নেই তাই তিনি কােন আসনে বসার কথা নয় বরং তিনি

হবেন মহাবিশ্বের সর্বেসর্বা প্রভু। তাঁর এই আসনে বসাটা প্রতীকী। হয়তো আল্লাহর সুসংহত অবস্থান বুঝাতেই রাজসিংহাসনের অবতারনা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়- মানুষ ঈশ্বরকে নিজের মত করে ত্রিমাত্রিক মানসচিত্রে কল্পনা করে নিয়েছে।’

সুরা কিয়ামা’তে বলা হয়েছে : ‘সেদিন কােন কােন মানুষের মুখ উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের

প্রতিপালকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে।’ ( ৭৫:২২-২৩)। এখান থেকে বুঝায় যে, পুণ্যবান নর-নারী আল্লাহর প্রতি

মনোনিবেশ করবে। কোরআনে বারবার একথা পুনরাবৃতি হয়েছে যে, ‘আল্লাহ সর্বদ্রষ্টা ও সর্বজ্ঞানী’- এ থেকে আমরা বুঝি কােন

কিছুই আল্লাহর অজানা নেই।

যাই হোক, অনেক মুসলমান বিশ্বাসের পক্ষে অনমনীয়। তারা কোরআনের যে ব্যাখ্যা হাদিসে আছে শুধু তা-ই গ্রহণ করেত চান এবং মনে করেন ধর্মীয় ব্যাপারে এর বাইরে কােন যুক্তি বা বিচার-বুদ্ধির প্রয়োগ অনুমোদনযোগ্য নয়। অনেক ক্ষেত্রে হাদিসও খোঁজেন না মুল্লামুন্সির নিজস্ব ব্যাখ্যাকে পরম জ্ঞান মনে করে আকড়ে ধরেন। তারা কোরআনেরআয়াতগুলােকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করেন এবং বিশ্বাস বা ধারনা করেন আল্লাহর মানুষের মতই মাথা, মুখ, চোখ, হাত, পা রয়েছে।

এবং তিনি ঠিক মানুষের মতই অনুভুতিক্ষমতা সম্পন্ন। কারণ কোরআনে আল্লাহর শোনা, বলা, দেখা এবং মানবসুলভ বিভিন্ন গুণের কথা উল্লেখ আছে। বাগদাদের একজন ধর্ম প্রচারক আবু মা’মার আল হুজাইলি’র (মৃত্যু ২৩৬ হজির বা ৮৫০ খৃষ্টাব্দ) মতে

কেউ যদি এরকম আক্ষরিক ব্যাখ্যা অবিশ্বাস করে তবে সে কাফের। বিখ্যাত ইমাম আহমদ বিন হানবল কেরআনের আক্ষরিক

অর্থকেই গ্রহণ করেছেন এবং এর প্রত আজীবন অবিচল ছিলেন। এই মজহাবের পরবর্তী প্রধান আহমদ বিন তায়মিয়া এ-ব্যাপারে

এতই গভীর বিশ্বাসী ছিলেন যে তিনি মুতাজিলাদের কাফের ও বিশিষ্ট ইসলামি দার্শনিক গাজ্জালিকে ধধর্মবিরোধী বলে মনে

করেতন। একদিন তিনি দামেস্কের প্রধান মসজিদে (উমাইয়া মসজিদ) উপস্থিত জনগণের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় ভাষণ শেষে মিম্বর থেকে

নামতে নামতে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তাঁর সিংহাসন (আরশ) থেকে এভাবে নামবেন যেভাবে আমি নামছি।’

এই ধরনের রক্ষণশীল মানিসকতাসম্পন্ন ধর্মান্ধরা শুধু মুতাজিলাদের নয় বরং আশারির মত ধর্মতাত্ত্বিকদেরও অনৈসলামিক বলে মনে করতেন। তারা তাদের সংকীর্ণ ধর্মীয় ব্যাখ্যার ভিন্নব্যাখ্যাকে ‘বিপদজনক উদ্ভাবন’ বলে অভিহিত করতেন। আবু আমর আলকোরেশি ঘোষণা দিয়েছিলেন সুরা শুরা’র ১১ নম্বর আয়াত : ‘কােনকিছুই তাঁর মত নয়’ যা প্রকাশ করছে তা সরাসরি গ্রহণ করা

ধর্মবিরুদ্ধ। তাঁর মতে এ আয়াত দ্বারা কেবল বুঝায় আল্লাহর সদৃশ্য কােন পরম সত্ত্বা নেই। কারণ আল্লাহর মানুষের মতোই

অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে। আবু আমর আল কােরেশি শেষ বিচার সংক্রান্ত সুরা কলমের একটি আয়াতের কথা বলেছেন : ‘সেই দারুণ

সংকটের দিনে যেদিন ওদেরকে সিজদা করার জন্য ডাকা হবে, ( সেদিন) কিন্তু ওরা তা করতে পারবে না। (৬৮:৪২)। এরপর

কোরেশি নিজের ঊরুতে হাত দিয়ে আঘাত করে বলেছিলেন, ‘আল্লাহরও ঠিক আমার মত হাত-পা রয়েছে।’

কোরানের একাধিক আয়াতে হেজাজের সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। এসব আয়াতে ধর্মীয় আদেশ-

নিষেধের সাথে তৎকালীন বিভিন্ন ঘটনা ও সংঘাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। বিভিন্ন বিতর্ক, রটনাকারীদের কুৎসার জবাব,

ব্যক্তিগত ঝগড়ায় মধ্যস্থতা, যুদ্ধের জন্য সনির্বন্ধ আহ্বান, মুনাফেকদের নিন্দা, যুদ্ধলব্ধ মাল, নারীর প্রতি নির্দেশ এবং

বিরোধীপক্ষ ও অবিশ্বাসীদের মৃতুর পর দোজখের আগুনের হুমকি দিয়ে কোরানে শতাধিক আয়াত রয়েছে। নগরের বাসিন্ধারা

যদি পাপকাজে লিপ্ত থাকে তবে শ্রষ্টার ক্রোধে গোটা নগর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, পূর্বে এরকম গজব নাজেল হয়েছিল পুণ্যবান-

পাপী সবার ওপর।

এতএব একথা সহজেই অনুমেয় যে, কোরানে শ্রষ্টার মানবসূলভ গুণাবলী আছে। তিনি খুশি হোন, তিনি ক্রোধান্বিতও হোন। তাঁর পছন্দ-অপছন্দবোধ রয়েছে এবং তাঁকে সন্তুষ্ট

করা সম্ভব। এককথায় মানুষের সব ধরনের মানবীয় গুণাবলী ও স্বভাব শ্রষ্টার রয়েছে- যেমন ভালবাসা, রাগ করা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা (মুনাফেকদের ব্যাপারে)  ষড়যন্ত্র, ছলনা ইত্যাদি।

(সুরা কালমে রয়েছে : ‘যারা এই বাণী প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, আমি ধীরে ধীরে ওদেরকে কোনদিকে নিয়ে যাব

ওরা তা জানে না। আমি ওদেরকে সময় দিয়ে থাকি। আমার কৌশল অত্যান্ত শক্ত।’( ৬৮:৪৪-৪৫)। সুরা আ’রাফ-এ রয়েছে :

‘যারা আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে আমি তাদেরকে ক্রমে ক্রমে এমনভাবে ধ্বংশের দিকে নিয়ে যাই যে, তারা জানতেও পারে না। আমি তাদেরকে সময় দিয়ে থাকি। আমার কৌশল বড়ই নিপুণ।’

(৭:১৮২-১৮৩)।

সুরা আনফালে কুরাইশ-প্রধানদের

গোপন সভাকে উদ্যেশ্য করে বলা হয়েছে : ‘স্মরণ করো, অবিশ্বাসীরা তোমার বিরোদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল- তোমােকে বন্দী, হত্যা বা

নির্বাসিত করার জন্য। তারা যেমন ছলনা করত, তেমনই আল্লাহও ছলনা করেতন। বস্তুত আল্লাহর ছলনা সবেচেয় উত্তম”)

যেহেতু বলা হয়ে থাকে, বিশাল এই মহাবিশ্বে একজনমাত্র  শ্রষ্টা রয়েছেন, এতএব যৌক্তিকভাবে ধরে নিতে হবে সেই শ্রষ্টার আমাদের মত নগন্য মানুষের মানিবক বৈশিষ্ট ও দূর্বলতা থেকে মুক্ত। কিন্তু আমরা কোরানের শ্রষ্টার বৈশিষ্টাবলী হজরত মুহাম্মদের নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত বলে ধরে নিতে বাধ্য। আর হজরত মুহাম্মদ নিজেই বলেছেন তিনি নিজেও একজন মানুষ মাত্র। আমরা জানি তিনি অন্যান্য মানুষের মত মনে কষ্ট পেতেন, ছেলে হারানোর ব্যথায় কাতর হয়েছেন, ওহুদের যুদ্ধে তাঁর চাচা হামজার বিকৃত লাশ দেখে শোকাতুর হয়ে প্রতিশােধের শপথ নিয়েছেন।

পূর্বে উল্লেখিত বিষয়গুলো পর্যবেক্ষন করলে প্রশ্ন আসে, কোরান, হজরত মুহাম্মদ ও আল্লাহকে কি আদৌ আলাদা করা সম্ভব নাকি

দুজন আসলে একই সত্ত্বা? কোরানের প্রচুর সুরা-আয়াত পর্যালোচনা করলে ঘুরে-ফিরে এই প্রশ্ন সামনে চলে আসে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আরও কয়েকটি প্রসঙ্গ আলোচনা করা দরকার। সকল মুসলমান বিশ্বাস করেন কোরান আল্লাহর বাণী। এই

বিশ্বাস কোরানেরই কিছু আয়াতের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে, যেমন: ‘কোরান ওহি, যা প্রত্যাদেশ হয়।’ (সুরা নজম :

আয়াত ৪-৫)।

‘আমি কোরান অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে।’ ( সুরা কাদর : আয়াত ১)।

কোরান মুসলমানদের বিশ্বাসের একমাত্র দলিল, যা অবিসংবাদিত, রাজকীয় ও পরম পবিত্র বলে বিবেচিত হয়।

শুরু থেকে কোরানকে এত বেশি মর্যাদাশীল বলে ভাবা শুরু হয় যে (কোরান রচিত হওয়ার) মাত্র একশ’বছরের মধ্যে মুসলিম

পন্ডিতদের কিছু জিজ্ঞাসার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, কোরান সৃষ্ট নাকি তা আল্লাহর মতই অসৃষ্ট, মানে তা কখনো অস্তিত্বহীন ছিল না।

এই বিতর্ক চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। কিন্তু কোরান অসৃষ্ট হওয়ার বিষয়টি ইসলামি ধর্মতত্ত্বের মৌলিক নীতিমালার সাথে

সাংঘর্ষিক।

তথাপি আব্বাসীয় খলিফা মুতাসিমের (৮৩৩-৮৪২ খৃষ্টাব্দ) শাসনামলে সুন্নি ইমাম আহমদ বিন হানবল কোরানের অসৃষ্ট হওয়ার

মতবাদকে পরিত্যাগ করা দূরের কথা এ ব্যাপারে তাঁর বিশ্বাস এতই প্রবল ছিল যে তিনি বরং অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত এজন্য

চাবুকের আঘাত সহ্য করে নেন। অর্থাৎ তিনি ‘আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোক’ আয়াতখানিও আল্লাহর মতই চিরন্তন বলে মনে

করতেন। [কোরান অসৃষ্ট বিষয়টি ইমাম আহমদ বিন হানবলের মতো ব্যক্তিদের গভীর বিশ্বাসের মূলে রয়েছে কোরােনর একাধিক

আয়াত। যেমন সুরা বুরজে বলা হয়েছে : ‘বস্তুত এই হচ্ছে সম্মানিত কোরান, যা রয়েছে লাওহে মাহফজে (সংরক্ষিত

ফলকে)।’( ৮৫:২১-২২)। লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত কোরান লিখেছিলেন পবিত্র সম্মানিত ফেরেশতারা। (দেখুন : ৮০ সুরা

আ’বাসা : আয়াত ১৩-১৬)

বিশ্বাসের মােহে আবদ্ধ থাকলে কাওকে  যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে লাভ হয় না। বিষয়টি তাদের জন্য সত্য, যারা কোরান পড়েছেন।

কোরানের প্রথম সুরা ফাতেহা একটি গুরুত্ববহ উদাহরণ হতে পারে। এই সুরায় সাতটি আয়াত রয়েছে এবং একে ‘সাত পুনরাবৃত্তি’ বলে। এই  সুরার বিশেষ মর্যাদার জন্য একে কোরানের সর্বপ্রথমে স্থান দেয়া হয়েছে। সুরাটির অনুবাদ দেখা যাক:-

‘পরম করুণাময় পরম দয়াময় আল্লাহর নামে

সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব্জগতের প্রতিপালক আল্লাহরই,

যিনি পরম করুণাময়, পরম দয়াময়

বিচারদিনের মালিক।

আমরা একমাত্র তোমারই উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

তুমি আমাদেরকে চালিত করো সঠিক পথে-

তাদের পথে যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছো,

তাদের পথ নয় যারা (তোমার) রােষে পতিত, এবং নয় তাদের পথ যারা পথভ্রষ্টও।’

এই বাক্যগুলো আল্লাহর হতে পারে না। এর বিষয়বস্তু থেকে এটা প্রতীয়মান যে, এটি নবির (শ্রষ্টার প্রশংসাকারী অন্য কারো) রচিত

কথামালা, কারণ এখানে আল্লাহর প্রশংসা রয়েছে, আল্লাহর প্রতি আকুতি ও  মিনতি রয়েছে। শ্রষ্টা কখনো নিজের প্রতি বলবেন না- ‘আমরা একমাত্র তোমারই  উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’

বাক্যের এই বিড়ম্বনা এড়ানো যেত যদি সুরাটির আগে ‘বল’ ( আরবিতে- ‘কুল’) বা ‘ এই বলে প্রার্থনা কর’ কথাটি সংযুক্ত থাকত; যেমন রয়েছে সুরা ইখলাস-এর প্রথম

আয়াতে (বলো, ‘তিনি আল্লাহ (যিনি) অদ্বিতীয়), সুরা কাফিরুনে আছে (বলো, ‘হে অবিশ্বাসীরা!’) কিংবা সুরা কাহাফ-এ রয়েছে,

‘বলো, ‘আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ; আমার ওপর প্রত্যাদেশ হয় যে আল্লাহই তোমাদের একমাত্র

উপাস্য।’( ১৮:১১০)। এটি যৌক্তিকভাবে অসম্ভব যে, এই বিশ্বচরাচরের শ্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালা কখনো বলবেন, ‘আমরা

একমাত্র তোমারই  উপাসনা করি, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ যেহেতু সুরা ফাতেহা কেবলমাত্র আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর প্রতি মিনতি ছাড়া কিছুই নয় তাই ধারণা করা যুক্তিযুক্ত যে, এই সুরা আল্লাহর বাণী নয় বরং নবির দোয়া বা প্রার্থনা। বিখ্যাত

সাহাবি, কোরানের হাফেজ, হাদিস-বক্তা ও কোরানের অনুলেখক আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ সুরা ফাতেহার এই আয়াতকে তাঁর

অনুমোদিত কোরানে অন্তর্ভুক্ত করেননি এবং সুরা ফালাক ও সুরা নাসকেও তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন।

গোঁড়া ধর্মবাদীদের এ-রকম বিশ্বাস ইসলাম-পূর্ব যুগের আদিম বিশ্বাস ও প্রথার কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। আরবদেরমধ্য থেকে হঠাৎ করে জড়বাদী ধারণা, বিমুর্ত চিন্তায় অক্ষমতা, আধ্যাতিক নির্লিপ্ততা, উশৃঙ্খলতা ও একগুঁয়েমি দূর হয়ে গেছে

এমন নয়। সর্বোপরি তাদের মন-মানসিকতা ইরানীয়দের মতো কােন ভিন্ন জাতি দ্বারা প্রভাবিত হয়নি অথবা তারা বিভিন্ন ইসলামি

বুদ্ধিবৃত্তিক দল যেমন মুতাজিলা, সুফি, শিয়া, ইখওয়ানুস-সাম এবং বােতনাইতদের সংস্পর্শে আসেনি।

এটা সবিদিত যে, মৌলবাদের ধারা আরবীয়দের মধ্য থেকে আগত এবং ইসলােমর প্রথম দিকের বুূ্দ্ধিবৃত্তিক চর্চা অ-আরবীয়দের

কাছ থেকে এসেছে। মুতাজিলা ও তাদের পরবর্তী চিন্তাবিদরা হয় অ-আরবীয় অথবা এরকম আরবীয় যারা গ্রীক ও ইরানীয় প্রভাবে

আদিম সংসার থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন। সবশেষে বলা যায় এসব বিষয় প্রথম দিকে দেয়া অভিমতটিকে প্রমাণকরে,- ‘মানুষ তার মানবীয় চিন্তার বাইরে ঈশ্বরকে রাখতে পারেনি। তাই সে ঈশ্বরকে তার নিজের মত করে কল্পনা করে নিয়েছে। মহিমান্বিত আল্লাহকে বিশ্বভ্রষ্মান্ডের অধিপতি ভাবতে হলে, আল্লাহকে যে বিশেষণ দেওয়া উচিত তা দিতে হলে আগে তাঁর অধিনস্ত বিশ্বভুবণকে জ্ঞান করতে হয়। অথচ মানুষ সেটা না করে বেমালুম ঈশ্বরের মানবিক মুর্তি দাড় করাচ্ছে যা সে নিজেও জানেনা। এতে করে সে তার প্রভুকে নিজের সমতায় নিয়ে এসেছে একথা ঘুণাক্ষরেও ভাবছে না।

বেশিররভাগ মানুষই তার অর্জিত বিশ্বাসের মাঝে বন্দী, এবং শারীরিক ও সহজাত প্রবৃত্তির প্রতি অনুগত। আর এই বন্দীত্ব ও আনুগত্যের ফলে মানুষের

যৌক্তিক ক্ষমতা হ্রাস পায়। পরিষ্কারভাবে চিন্তা-বিশ্লেষণ মানুষ করতে পারেনা। তখন তারা সেসব আসল ঘটনাকে উপেক্ষা করে, যা

তাদের বিশ্বাসের সাথে সংঘাত সৃষ্টি করে। তারা শুধুমাত্র যা কিছুর মধ্যে তাদের ধারণা ও বিশ্বাসের আলামত পায় নূন্যতম সাদৃশ্য দেখে তা’ই আঁকড়ে ধরে।

মানুষের এই আচরণ ও মানিসকতাই হচ্ছে কুসংস্কার এবং বিভ্রম বিস্তারের কারণ।

আগের বছর আপনি কোন ঠাকুর বা পীরের মাজারে গিয়ে ঐ পীর/ঠাকুর সম্পর্কে চালু থাকা অলৌকিক গল্পগুলো শুনে আসুন। পরের বছর আবার গিয়ে দেখবেন গল্প আগের জায়গায় থাকেনি। ফুলে-ফেপে মহীরুহ আকার ধারন করেছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে ভক্তকুলও বেড়েছে। এসব অলৌকিক গল্প বিশ্বাসের বন্দীদশা থেকে সৃষ্ট। সত্যিকার অর্থে সবগুলো গল্পই এভাবেই আসল ঘটনাকে পাশ কেটে অন্ধভক্তি অথবা বিশ্বাসের দাসত্ব থেকে উৎসারিত। যেখানে লজিকের, তথ্যের কিংবা কার্য-কারণ সম্পর্কের কোন গুরুত্ব নাই।

এনিওয়ে, কেন জানি মনে হচ্ছে অলৌকিক গল্প দিয়ে ইজমকে সমাজে বা রাস্ট্রে বেশিদিন ঠিকিয়ে রাখা যাবেনা। ঠিকানোর জোর প্রয়াস চালালে কতিপয় অনুরাগী ছাড়া বাদবাকি সমাজ এসব অলিক ইজমকে পেছনে ফেলে ঠিকই সামনে এগিয়ে যাবে।

লেখক: কবি, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।