মধ্যবিত্তের স্বপ্নপূরণের সিঁড়ি সাপ্তাহিক গাড়ির হাট

প্রকাশিত:শুক্রবার, ২৪ মে ২০২৪ ০১:০৫

মধ্যবিত্তের স্বপ্নপূরণের সিঁড়ি সাপ্তাহিক গাড়ির হাট

নিউজ ডেস্ক: এ চিত্র রাজধানী ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ এলাকার রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের পুরোনো গাড়ির হাটের। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এ মাঠে প্রতি শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলে পুরোনো গাড়ির প্রদর্শনী। মধ্যবিত্ত ক্রেতারা কম দামে ভালো মানের গাড়ির কেনার সুযোগ পান এ হাট থেকে। ‘কার হাট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান এমন আয়োজন করে আসছে ১৯৯৯ সাল থেকে।

শুক্রবার (২৪ মে) সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, স্কুলের মাঠে ১২০টি গাড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। নতুন-পুরাতন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গাড়ি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিক্রেতারা নিয়ে এসেছেন। হাটে পুরোনো গাড়ির ব্যবসা করেন এমন বিক্রেতা ছাড়াও সাধারণ বিক্রেতারাও তাদের গাড়ি প্রদর্শনীতে রেখেছেন। তবে সবসময় যে পুরোনো গাড়িই বিক্রি হয় তেমনটি নয়, মাঝেমধ্যে এখানে ব্র্যান্ড নিউ গাড়িও নিয়ে আসেন বিক্রেতারা। আর ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে পছন্দের গাড়ির তথ্য জানতে পারেন। অনেক নতুন ক্রেতা সঙ্গে নিয়ে আসেন গাড়ির এক্সপার্টদেরও। তারাই দেখেশুনে গাড়ি পছন্দ করে দেন। আর গাড়ির যে দাম হাঁকা হয় সেটি নির্ধারিত নয়, রয়েছে দরকষাকষির সুযোগ।

এক্ষেত্রে নতুন ক্রেতাদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, কাগজপত্রের ঝামেলা মাথায় নিতে হচ্ছে না। কারণ পুরো বিষয়টির মধ্যস্থতা করে দেয় ‘কার হাট’। গাড়ির সব কাগজপত্র ঠিক আছে কি না, তথ্য হালনাগাদ করা রয়েছে কি না এমনকি গাড়ির নামে আগের কোনো মামলা আছে কি না, এসব বিষয় তারাই নিশ্চিত করেন। গাড়ি কেনার পরও যদি এ সংক্রান্ত কোনো সমস্যা দেখা দেয় তাহলে এর দায়ভারও তারাই নিয়ে থাকেন।

আয়োজকরা জানান, এ জায়গা থেকে গাড়ি কিনে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ যাবতীয় বিষয়াদি যাচাই-বাছাই করেই তারপর প্রদর্শনীর জন্য আনা হয়। আর কাগজপত্রও রাখা হয় কার হাট কর্তৃপক্ষের কাছে। তাদের তত্ত্বাবধানেই ক্রেতা গাড়ির ডাউন পেমেন্ট পরিশোধ করে পরবর্তী কার্যক্রম সম্পন্ন করেন।

কার হাটের জেনারেল ম্যানেজার মো. মুরাদ হোসেন বলেন, ১৯৯৯ সালের ১৩ আগস্ট প্রথমবার কার হাট এমন প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এই একই জায়গায় প্রতি সপ্তাহে প্রদর্শনী চলছে। ছয়জন তরুণ উদ্যোক্তার ছোট উদ্যোগই আজ বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে। মূলত ওই সময় একজন ক্রেতা যখন গাড়ি কিনতে চাইতেন, তাকে নানান ধরনের হয়রানির মুখোমুখি হতে হতো। কারণ তখন এত শোরুম কিংবা অনলাইন সিস্টেম ছিল না। ক্রেতা যেন স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে গাড়ি কিনতে পারেন সেই চিন্তা থেকেই কার হাট যাত্রা করেছিল। ১৯৯৯ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ২০ হাজার গাড়ি আমরা বিক্রি করেছি। সারা দেশে আমাদের বিরাট একটি কাস্টমার বেজ তৈরি হয়েছে। ফলে কার হাট বর্তমানে দেশব্যাপী গাড়ি কেনা-বেচার জনপ্রিয় একটি প্ল্যাটফর্ম।

তিনি বলেন, গাড়ি কিনতে এসে একজন ক্রেতার যত ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, সবই আমরা করি। এখানে একজন ক্রেতা একসঙ্গে ১২০টি গাড়ি সরাসরি নিজে দেখে যাচাই-বাছাই করতে পারছেন। দামও হাতের নাগালে রয়েছে। এরপর কাগজের যাবতীয় নিশ্চয়তাও আমরা নিশ্চিত করছি। গাড়ির মালিকানা বদলসহ সব ধরনের সেবাই আমরা দিয়ে থাকি। এ ছাড়া কার হাটে সর্বনিম্ন ৩ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ৫০-৬০ লাখ টাকার গাড়ি রয়েছে বলে জানান তিনি।

ক্রেতারা বলছেন, সাধ্যের মধ্যে মধ্যবিত্তের গাড়ির স্বপ্নপূরণ হচ্ছে কার হাটের এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। তবে এক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা রেখেই দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে।

রাজধানীর বাড্ডা থেকে গাড়ি কিনতে আসা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগে আমার ছোট ভাই এই জায়গা থেকে টয়োটা প্রিমিও গাড়ি কিনেছে। ১২ লাখ টাকায় কেনা ব্যবহৃত গাড়িটি বেশ ভালোই সার্ভিস দিচ্ছে। সেজন্য আমিও আগ্রহী হয়েছি। এখন ঘুরে দেখছি, আমার বাজেট ১৫ থেকে ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভালো মানের একটি প্রাইভেটকার পেলে কিনে নেব। তাছাড়া এখান থেকে গাড়ি নিলে কাগজপত্রের ঝামেলা নেই। অনেক সময় ব্যবহৃত গাড়ি কিনলেই চোরাই হওয়ার সম্ভব থাকে। এখানে তেমন সমস্যা নেই। একটি গাড়ি পছন্দ হয়েছে। দামাদামি করছি। দেখি কত টাকায় নেওয়া যায়।

নিজামুদ্দিন খসরু নামের আরেক ক্রেতা বলেন, আমার একটি গাড়ি আছে। এটি বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। তাই এখান থেকে ব্যবহৃত একটি গাড়ি নিতে এসেছি। গত সপ্তাহে এসেও ঘুরে দেখেছি। ১০-১৫ লাখ টাকা হলে এখানে ভালো গাড়ি পাওয়া যায়। যেহেতু কাগজপত্র কার হাটের তত্ত্বাবধানেই হয়, সেজন্য অন্য কোনো সমস্যা হয় না। তবে গাড়ি অবশ্যই দেখে শুনে নিতে হয়। কেননা বেশি পুরোনো গাড়ি কিনলে আবার তার মেইনটেনেন্সের জন্য বাড়তি খরচ করতে হয়।

বিক্রেতারা বলছেন, এমন প্রদর্শনীর মাধ্যমে খুব সহজে দালাল ছাড়াই সরাসরি নিজে উপস্থিত থেকে গাড়ি বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে।

নাইমুর রহমান নামের এক গাড়ি বিক্রেতা বলেন, এখান থেকে আপনি দেখে শুনে ভালো গাড়ি কিনতে পারলে অনেকদিন ব্যবহার করতে পারবেন। অনেক বিদেশি এনজিও অথবা কোম্পানি রিকন্ডিশন গাড়ি বাংলাদেশে এনে তাদের প্রকল্পের কাজ করেন। এসব গাড়ি অল্প কিছুদিন পরেই আবার বিক্রির জন্য এখানে তোলা হয়। অল্প দামে এগুলো ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য খুব ভালো হয়। আর দামও থাকে হাতের নাগালে। আবার পছন্দ হলে দামাদামির সুযোগ রয়েছে।

প্রতি সপ্তাহে এই হাটে ১৫-২০টি গাড়ি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান কার হাটের এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার মো. আহসান উল আলম। তিনি বলেন, কার হাট হচ্ছে বায়ার ও সেলারের একটি হাব। ক্রেতা-বিক্রেতা দুজনেই এখানে আসেন। ৪৫ জন কর্মী এখানে আগত মানুষজনকে সেবা দিয়ে থাকেন। এখানে প্রদর্শনীর জন্য প্রতি বুধবার গাড়ি বাছাই করা হয়। গাড়ি ভালো কি না বা কাগজপত্র ঠিক আছে কি না সব কিছুই পরীক্ষা করা হয়। এরপর আমরা ম্যাপ শিট তৈরি করি। সে অনুযায়ী শুক্রবার সকালে গাড়ি সাজানো হয়। আমাদের দক্ষ বিক্রয় কর্মীরা সবাইকে সহযোগিতা করেন।

আহসান উল আলম বলেন, ক্রেতার পছন্দ করা গাড়ির দাম নির্ধারিত হলে ৫ শতাংশ অ্যাডভান্স পরিশোধ করতে হয়। তখন থেকে পরের এক সপ্তাহ সময় ক্রেতাকে দেওয়া হয়। এর মধ্যে যেকোনো সময় পুরো টাকা পরিশোধ করে গাড়ি ও কাগজপত্র বুঝে নিতে পারেন।

যাচাই-বাছাইয়ের পর অ্যাডভান্স করা গাড়ির সমস্যা পাওয়া গেলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়– জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন বিক্রেতার সঙ্গে আমরা যখন গাড়ি বিক্রির চুক্তি করি তখন এ বিষয়গুলো উল্লেখ করা থাকে। যেকোনো সমস্যা হলে গাড়ি পাল্টে দেওয়ার শর্ত আগেই আরোপ করা থাকে। এটা নিয়ে ক্রেতাদের হয়রানির সুযোগ নেই। এমনকি কোনো ক্রেতা যখন পছন্দের গাড়ির বায়না করেন তখনই সেই কার হাট কর্তৃপক্ষের জিম্মায় নিয়ে আসা হয়।