৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
প্রকাশিত:শুক্রবার, ৩১ মে ২০২৪ ০৩:০৫
নিউজ ডেস্ক: রাজধানীর গুলশান ও বনানীতে তিনটি পরিত্যক্ত বাড়ি আছে। এ বাড়ি তিনটি ভেঙে সরকারি কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য বহুতল ভবন বা ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে। এ জন্য ২১৭ কোটি টাকার প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
মিসরের রাজধানীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের জন্য বাসভবন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পে খরচ হবে ১৬৫ কোটি টাকা। আবার কক্সবাজার শহরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য রংবেরঙের সড়কবাতি, ভাস্কর্য ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পে ২৪ কোটি টাকা খরচ হবে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে শেষ হবে এ দুটি প্রকল্প।
এ ধরনের কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অননুমোদিত নতুন প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে এগুলোকে ‘উচ্চ’ অগ্রাধিকার নতুন প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করছে সরকার। দেশের অর্থনীতিতে যখন সংকট চলছে, ঘাটতি রয়েছে ডলার সরবরাহে, তখন এ ধরনের প্রকল্পকে উচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদেরা।
আগামী এডিপিতে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করার জন্য সব মিলিয়ে ৭৬৬টি নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই তালিকা ধরে আগামী অর্থবছরজুড়ে প্রকল্পগুলো পাস করা হবে। এর মধ্যে সরকার ৬৮২ প্রকল্পকে ‘উচ্চ’ অগ্রাধিকার দিয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে ৮২টি প্রকল্পকে ‘মধ্যম’ এবং ১৪টি প্রকল্পকে ‘নিম্ন’ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবছর নতুন এডিপি যখন পাস হয়, তখন সাধারণত আগের বছরের এক হাজারের বেশি চলমান প্রকল্প থাকে। এর সঙ্গে যোগ হয় ‘সবুজ পাতার অননুমোদিত নতুন প্রকল্প’। বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের বইয়ের সবুজ পাতায় সাধারণত এই ধরনের অননুমোদিত প্রকল্পগুলো তালিকাভুক্ত করা হয়।
দেশে ভর্তুকির মতো ব্যয় কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ রয়েছে। বাজেট ছোট রাখা ও ঘাটতি কমাতেও পরামর্শ এসেছে এই সংস্থার পক্ষ থেকে। সরকারের রাজস্ব আদায় প্রত্যাশিত পর্যায়ে নেই, অর্থসংকটের কারণে সার ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির টাকা পরিশোধ করতে না পেরে কয়েক হাজার কোটি টাকার বন্ড দিতে হয়েছে। বাজেটের বড় অংশের টাকা সরকার জোগান দিচ্ছে ঋণ করে। বাজেটের আয় ও ব্যয় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এডিপির পুরো অর্থই আসবে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণের মাধ্যমে।
এডিপির বই ঘেঁটে দেখা গেছে, দেশজ উৎস থেকে জোগান দেওয়া অর্থে অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের তালিকায় আরও কিছু অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আছে। যেমন নিঝুম দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগ সেতু নির্মাণ সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পে খরচ হবে ১৫ কোটি টাকা। আবার নেত্রকোনার উচিতপুর-খালিয়াজুরি উড়ালসড়ক নির্মাণ করতে চায় সরকার। এ জন্য ১২ কোটি টাকার একটি সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা করার প্রকল্পে উচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার।
এ ছাড়া অর্থসংকটের এ সময়ে ২৭০ কোটি টাকায় কর্মসংস্থান ব্যাংক ভবন নির্মাণ এবং ১১৫ কোটি টাকায় মিরপুরে তাঁত বোর্ড কমপ্লেক্স নির্মাণও এখন সরকারের উচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায় আছে। এই তালিকায় আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, গাজীপুর, ফরিদপুর, বাগেরহাটসহ বেশ কয়েকটি জেলায় সার্কিট হাউস ভবন নির্মাণ।
এডিপির সবুজ পাতায় অননুমোদিত নতুন প্রকল্পে (যা নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হবে) তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেখানের ভবন ও রাস্তাঘাট নির্মাণের প্রকল্পই বেশি।
বড় অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে সংকট আছে। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এসব প্রকল্প কোনোভাবে উচ্চ অগ্রাধিকার হতে পারে না। এসব প্রকল্পের লক্ষ্য কী? মানুষের কী উপকার হবে? এসব বিবেচনা করতে হবে। উৎপাদন বাড়ায় এমন প্রকল্পই এখন উচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।’
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আরও বলেন, যখন অর্থনীতিতে ভালো সময় থাকবেন, হাতে অনেক টাকা থাকবে—তখন এ ধরনের ভবন নির্মাণের প্রকল্প করা যেতে পারে। সার্কিট হাউস না হলে এখনই তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। এ মুহূর্তে সরকারি কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট না হলেও তেমন ক্ষতি নেই।
নানা সংকটে অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক এখন নিম্নমুখী। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে সরকার আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) পাস হয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি)। নতুন এডিপিতে মোট প্রকল্প সংখ্যা ১ হাজার ৩২১।
এত কম টাকা বাড়েনি কখনো
মূলত অর্থসংকটের কারণেই আগামী বছরের এডিপির আকার খুব একটা বাড়ানো সম্ভব হয়নি। গতবারের মূল এডিপি থেকে নতুন এডিপি মাত্র দুই হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।
এডিপিতে স্থানীয় মুদ্রায় আগের বছরের চেয়ে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এডিপির জন্য স্থানীয় উৎস থেকে আসবে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে মূল এডিপিতে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। ফলে স্থানীয় মুদ্রায় এডিপি বরাদ্দ কমেছে চার হাজার কোটি টাকা। আগামী এডিপিতে এক লাখ কোটি টাকা প্রকল্প সাহায্য হিসেবে পাওয়া যাবে। এই প্রথমবারের মতো বিদেশি সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্য এক লাখ কোটি টাকা ছাড়াচ্ছে। চলতি এডিপিতে বিদেশ থেকে পাওয়া প্রকল্প সাহায্য ছয় হাজার কোটি টাকা কম ছিল। স্থানীয় উৎস থেকে টাকার জোগান কমে যাওয়ার কারণেই বিদেশি অর্থের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে সরকারকে।
এডিপির আকার কমে যাওয়া প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এর পেছনে মূল কারণ হলো বর্তমান সময়ে কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। ফলে শুধু যে এডিপির আকার বড় করা যাচ্ছে না, তা–ই নয়, আগের বছরের চেয়ে স্থানীয় মুদ্রায় বরাদ্দও কমিয়ে দিতে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এডিপি বাড়ানোর মতো যথেষ্ট আর্থিক সামর্থ্য সরকারের এই মুহূর্তে নেই। প্রতিবছর রাজস্ব আদায় প্রবৃদ্ধি ১০-১২ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে এবং রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চেষ্টা খুব একটা সফল হচ্ছে না। ফলে সরকারের হাতে যথেষ্ট অর্থ না থাকার কারণে বিভিন্ন দায় পরিশোধ করতেও সমস্যা হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতির এই সংকটের সময়ে এ ধরনের বিলাসী মানসিকতার প্রকল্প অনুমোদন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। যখন আমরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কৃচ্ছ্রসাধন করার কথা শুনি, তখন আশ্চর্যই হতে হয় এই ভেবে যে কীভাবে এ ধরনের প্রকল্প অনুমোদন পেতে পারে। অবশ্যই বাজেট প্রস্তাবনায় এ ধরনের প্রকল্প বাতিল করা প্রয়োজন।
শিক্ষা–স্বাস্থ্যে অগ্রাধিকার কম
উন্নয়ন খাতে সরকার অগুরুত্বপূর্ণ নানা প্রকল্প হাতে নিলেও প্রতিবারের মতো এবারেও শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের চেয়ে রাস্তাঘাট ও জ্বালানি খাতকে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়েছে। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে শীর্ষ তিনটি খাতের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত নেই। শীর্ষ তিন খাতে আছে স্থানীয় সরকার বিভাগ; সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং বিদ্যুৎ বিভাগ। এ তিনটি খাতই এডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ বরাদ্দ পাচ্ছে। এসব মন্ত্রণালয় জনতুষ্টির বিভিন্ন প্রকল্প নেয়, যার মাধ্যমে উন্নয়ন সহজে দৃশ্যমান হয়।
এর বিপরীতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত সব মিলিয়ে পাচ্ছে এডিপির ২০ শতাংশের কম।
অন্যদিকে আগামী এডিপিতে শীর্ষ পাঁচটি প্রকল্প পেয়েছে ৩৫ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। যা মোট এডিপির ১৩ শতাংশের মতো।
‘ব্যর্থ’ পিপিপি প্রকল্পের বরাদ্দ
২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে প্রথমবারের মতো পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের ধারণা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু গত দেড় দশকে পিপিপি প্রকল্পে সাফল্য মেলেনি বললেই চলে। রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়েছে, এটিই হলো সবচেয়ে দৃশ্যমান পিপিপি প্রকল্প।
প্রতিবার বাজেটে পিপিপি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়, এডিপিতে প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০টি প্রকল্পও রাখা হয়। কিন্তু পিপিপি প্রকল্পে কাজ হয় না। অর্থ অব্যবহৃত থেকে যায়। আগামী এডিপিতেও ৭৯টি পিপিপি প্রকল্প রাখা হয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগকারী পেলে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলে কর্মকর্তারা জানান।
সরকার যে ধরনের প্রকল্পকে উচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে
গুলশান ও বনানীতে সরকারি কর্মকর্তাদের বাসভবন।
মিসরে রাষ্ট্রদূতের জন্য বাসভবন।
কক্সবাজারে সড়কবাতি, ভাস্কর্য নির্মাণ।
নিঝুম দ্বীপের সঙ্গে সংযোগ সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই।
নেত্রকোনার উচিতপুর-খালিয়াজুরী উড়ালসড়ক নির্মাণ সমীক্ষা।
কর্মসংস্থান ব্যাংক ভবন নির্মাণ।
বিভিন্ন জেলায় সার্কিট হাউস নির্মাণ।
সম্পাদক ও প্রকাশক: এম. দেলোয়ার হোসেন
অফিস: অফিস: রোম নং-৫, নীচতলা, ১৭-১৮, বাইন কোর্ট, হোয়াইটচ্যাপল, লন্ডন।
মোবাইল: ০৭৩৭৭-৯৫১৬৮১