৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
প্রকাশিত:সোমবার, ০৩ জুন ২০২৪ ০১:০৬
নিউজ ডেস্ক: কাদম্বরী দেবী কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে বউ হয়ে এসেছিলেন মাত্র ৯ বছর বয়সে। ঠাকুর পরিবারে যে শিক্ষাদীক্ষার ঘাটতি ছিল, তা নয়। তবে রক্ষণশীলতার শিকল পুরোপুরি ছিঁড়তে পারেননি এই পরিবারের কর্তারাও। তাই দেখা যাচ্ছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন অগ্রসর মানুষ হয়েও তাঁর চেয়ে বয়সে ১০ বছরের ছোট কাদম্বরীকে বিয়ে করেন। পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথার বাইরে যাওয়ার সাধ্য তাঁর ছিল না। একই কথা প্রযোজ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রেও। ঠাকুর পরিবারের সবচেয়ে উজ্জ্বল কনিষ্ঠ পুত্রটি নিজের ২২ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন ৯ বছরের ভবতারিণীকে, পরে যাঁর নাম দেওয়া হয় মৃণালিনী দেবী।
মৃণালিনী গ্রামের মেয়ে ছিলেন। খুলনার দক্ষিণ ডিহিতে ঠাকুরদের একটি এস্টেটের কর্মচারীর মেয়ে ছিলেন মৃণালিনী। অন্যদিকে কাদম্বরী শহরের মেয়ে। তবে তাঁরা কেউই উচ্চবংশীয় পরিবারের ছিলেন না। কাদম্বরী অবশ্য কিছুটা ছিলেন বলা যায়। কাদম্বরীর পরিচয়টা একটু বিস্তারিত দেওয়ার প্রয়োজন আছে। তাঁর পারিবারিক নাম মাতঙ্গিনী। বিয়ের পর নাম হয় কাদম্বরী। তাঁর পিতামহ জগম্মোহন গঙ্গোপাধ্যায় গুণী সংগীতশিল্পী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের মামাতো বোন শিরোমনি দেবীকে বিয়ে করেন জগম্মোহন। সেই সূত্রে তিনি ঠাকুর পরিবারের জামাতা। এই পরিবারে বিয়ের সুবাদে যৌতুক হিসেবে কলকাতার হাড়কাটা লেনে একটি বাড়ি পেয়েছিলেন জগম্মোহন। জগম্মোহনের ছেলে শ্যাম গাঙ্গুলি ছিলেন ঠাকুর পরিবারের ‘বাজার সরকার’। এই শ্যামের মেয়েই কাদম্বরী।
বয়সে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কাদম্বরী দুই বছরের বড়। কাদম্বরী ও রবীন্দ্রনাথ একসঙ্গে গান শিখতেন জগম্মোহনের কাছে। রবীন্দ্রনাথ যে গাইতে পারতেন, তা এই জগম্মোহনেরই অবদান। যদিও শিল্পী হিসেবে কোনো দিন ঠাকুর পরিবারের কাছ থেকে কোনো স্বীকৃতি পাননি জগম্মোহন।
মূল কাহিনিতে যাওয়ার আগে বলে নেওয়া ভালো, পরিবারে অল্প বয়সী বউ আনলেও ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাঁদের শিক্ষিত করানোর দিকে বিশেষ মনোযোগ ছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কাদম্বরী ও মৃণালিনী—দুজনের ক্ষেত্রেই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা দিন কত কাজে ব্যস্ত। পারিবারিক ব্যবসা, লেখালেখি, নাটক নির্মাণ, চিত্রকর্ম। জনপ্রিয় মত হচ্ছে, স্ত্রী কাদম্বরীকে দেওয়ার মতো সময় তাঁর ছিল না বা কম ছিল।
অন্যদিকে একসঙ্গে গান শেখার সুবাদে নতুন এই বৌঠানের সঙ্গে সময় পেলেই নিজের চিন্তা ভাগাভাগি করতে চাইতেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু রক্ষণশীল ঠাকুরবাড়িতে চাইলেই নারীমহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করার সুযোগ ছিল না। রবির ইচ্ছে করত নতুন বৌঠানের সঙ্গে ভাব জমাতে, কিন্তু ভেতরমহলে যাওয়ার উপায় নেই। কখনো কাছে গিয়ে পৌঁছাতে পারলেও ছোড়দিদি বর্ণকুমারী তাড়া দিয়ে বলতেন, ‘এখানে তোমরা কী করতে এসেছ? যাও, বাইরে যাও।’
কেন আত্মহত্যা করেন কাদম্বরী
কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু হয় ২১ এপ্রিল ১৮৮৪ সালে। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ২৪ বছর। ১৫ বছরের কম সময় তিনি ঠাকুর পরিবারের বউ ছিলেন। তাঁর কোনো সন্তানাদি ছিল না।
কাদম্বরীর মৃত্যুর ১৪০ বছর পরও এ নিয়ে আলোচনা থামেনি। অতিরিক্ত আফিম খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তিন–চার দিনের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। এটা আত্মহত্যাই ছিল। মৃত্যুর আগে সুইসাইড নোট লিখে যান তিনি। এর আগেও একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন কাদম্বরী।
এখানে দুটো মত প্রচলিত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোব্বার পকেটে সেকালের এক বিখ্যাত অভিনেত্রীর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতার পরিচায়ক কতগুলো চিঠি পাওয়া যায়। চিঠিগুলো পেয়ে কাদম্বরী কদিন বিমনা হয়ে কাটান। চিঠিগুলোই তাঁর আত্মহত্যার কারণ।
দ্বিতীয় মত হলো, রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করায় কাদম্বরী আরও একাকী হয়ে পড়েন। হতাশ হয়ে পড়েন। তাই ছোট দেবরের বিয়ের চার মাসের মাথায় তিনি আত্মহত্যা করেন।
কাদম্বরীর আত্মহত্যার কারণ নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু তিনি যে আত্মহত্যা করেছিলেন, এ নিয়ে কোনো মতান্তর নেই।
তবে আত্মহত্যার কারণের মধ্যে প্রথম মতকে নাকি সমর্থন করে গেছেন রবীন্দ্রনাথের ছোট দিদি বর্ণকুমারী। স্বামীর পরকীয়াই তাঁর আত্মহত্যার কারণ, এ কথা নাকি স্বয়ং কাদম্বরী লিখে গিয়েছিলেন। আর বর্ণকুমারী দেবীই সাংবাদিক অমল হোমকে বলেছিলেন পুরো কথাটি।
কাদম্বরীর সেই লেখা ও চিঠি সবই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের আদেশে নষ্ট করে ফেলা হয়। শোনা যায়, প্রথা অনুযায়ী কাদম্বরীর দেহ মর্গে পাঠানো হয়নি, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই বসানো হয়েছিল ‘করোনার্স কোর্ট’। গবেষকদের একাংশ মনে করেন, স্বয়ং মহর্ষির উদ্যোগেই রিপোর্ট লোপ করা হয়। ৫২ টাকা ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করা হয় সংবাদমাধ্যমের। তাই কাদম্বরীর মৃত্যুসংবাদ তখন কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়নি।
কাদম্বরী দেবীর এই ‘সুইসাইড নোট’ নিয়ে লেখালেখি করেন কাজী আবদুল ওদুদ। তিনি সূত্র হিসেবে উল্লেখ করেন বর্ণকুমারী ও অমল হোমকে। বিষয়টা হলো, কাদম্বরী আত্মহত্যার চিরকুট লিখে গিয়েছিলেন, এ কথা অমল হোম শুনেছিলেন বর্ণকুমারীর কাছ থেকে। আর কাজী আবদুল ওদুদ শোনেন অমল হোমের মাধ্যমে।
তবে ওদুদকে খারিজ করে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন, ‘এ-বিষয়ে অমল হোমের কোনো লেখা আমরা দেখিনি, সুতরাং বর্ণকুমারী দেবীর মুখে তাঁর শোনা কথা এবং তাঁর মুখে ওদুদ সাহেবের শোনা কথা কতখানি নির্ভরযোগ্য, সে সম্বন্ধে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক।
যে মৃত্যু নাড়া দিয়েছিল রবির অন্তর্জগৎকে
কাদম্বরীর মৃত্যু নাড়া দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তর্জগৎকে। ‘জীবনস্মৃতি’তে ‘মৃত্যুশোক’ অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনও দিন প্রত্যক্ষ করি নাই। কিন্তু আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল, তাহা স্থায়ী পরিচয়…। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া চলিয়াছে।’
কাদম্বরীর প্রয়াণের কিছুদিন পর ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নাম দিয়েছিলেন ‘আত্মা’।
সেই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘যে আত্মবিসর্জন করতে পারে, আত্মার উপর শ্রেষ্ঠ অধিকার শুধু তারই জন্মাতে পারে।’ এই প্রবন্ধ পড়ে এমন মনে হতে পারে যে ‘আত্মা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেন ইঙ্গিত দিলেন, কাদম্বরীর প্রয়াণ আসলে এক ‘আত্মবিসর্জন’।
এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
স্ত্রীর মৃত্যুর পর ৪১ বছর বেঁচে ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তবে ক্রমে নিজেকে গুটিয়ে নেন এবং মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সত্যেন্দ্রনাথের সন্তানদের সান্নিধ্য তিনি উপভোগ করতেন।
শেষ পর্যন্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কলকাতা ছেড়ে চলে যান, বিহার প্রদেশের রাঁচির মোরাবাড়ি পাহাড়ে একটি বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে থাকেন, যে বাড়ির নাম ছিল শান্তিধাম। সেখানে তিনি নির্জনবাসে জীবন কাটিয়ে দেন। সেখানে কেবল প্রতিকৃতি আঁকতেন তিনি। রাঁচিতেই ৭৬ বছর বয়সে ১৯২৫ সালের ৪ মার্চ মারা যান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সম্পাদক ও প্রকাশক: এম. দেলোয়ার হোসেন
অফিস: অফিস: রোম নং-৫, নীচতলা, ১৭-১৮, বাইন কোর্ট, হোয়াইটচ্যাপল, লন্ডন।
মোবাইল: ০৭৩৭৭-৯৫১৬৮১