৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
প্রকাশিত:মঙ্গলবার, ০৪ জুন ২০২৪ ১০:০৬
নিউজ ডেস্ক: মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল আটটা থেকে ভোটগণনার প্রক্রিয়া শুরু হবে, আর যেহেতু ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়েছে, তাই বিকেলের আগেই গোটা দেশের নির্বাচনি ফলাফল বা ‘ট্রেন্ড’ মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তার দল বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন জোট ‘এনডিএ’ একটানা তৃতীয়বার দেশের ক্ষমতায় আসার জন্য লড়ছে।
বিজেপির সেই লক্ষ্য সফল হলে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পর নরেন্দ্র মোদীই হবেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি পরপর তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করবেন।
অন্যদিকে, বিরোধী শিবিরের মূল জোট ‘ইন্ডিয়া’র নেতারাও আশাবাদী যে তারা সরকার গড়ার জন্য যে গরিষ্ঠতা দরকার, তা অর্জন করতে পারবেন।
‘ইন্ডিয়া’ জোটের সব চেয়ে বড় দল কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ভোটপর্ব মেটার পর দাবি করেছেন তাদের জোট ২৯৫ বা তার কাছাকাছি আসন পাবে বলে তাদের ধারণা। লোকসভায় নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য দরকার অন্তত ২৭২টি আসন।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট ‘এনডিএ’ বা বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের বাইরেও অবশ্য বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী আঞ্চলিক দল রয়েছে – অর্থাৎ এই দলগুলো ভোটে লড়েছে কোনও জোটের অংশ না-হয়েই।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ওড়িশার বিজু জনতা দল, অন্ধ্রের ওয়াই এস আর কংগ্রেস, উত্তরপ্রদেশে বহুজন সমাজ পার্টি প্রভৃতি রাজনৈতিক দল।
গত ১লা জুন সপ্তম দফার ভোটের শেষে ভারতের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা যে সব ‘এক্সিট পোল’ বা বুথফেরত সমীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে, তার বেশিরভাগ জরিপেই অবশ্য বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটকে বিপুলভাবে এগিয়ে রাখা হয়েছে।
তবে ভারতে এক্সিট পোলের পূর্বাভাস সম্পূর্ণ ভুল হওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আছে, যার মধ্যে সবশেষ বড় ঘটনাটি ঘটেছে মাত্র মাসছয়েক আগেই। ছত্তিশগড়, রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশে গত বিধানসভা নির্বাচনের প্রকৃত ফলাফল কোনও এক্সিট পোলই আন্দাজ করতে পারেনি।
ফলে ভারতের ৫৪৩ আসন-বিশিষ্ট লোকসভায় কোন দল বা কোন জোট শেষ পর্যন্ত ঠিক কত আসন পায়, তা নিশ্চিতভাবে জানার জন্য আজ বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও গতি নেই।
এরকম একটা টানটান উত্তেজনার মধ্যেই আজ সকাল থেকে সারা দেশের গণনাকেন্দ্রগুলোতে ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিটের সিল খুলে ভোটগণনার কাজ শুরু হবে।
দেশের প্রায় ১৪০ কোটি আবালবৃদ্ধবনিতা (যাদের প্রায় অর্ধেক এবারে ভোট দিয়েছেন) অধীর আগ্রহের সঙ্গে এই গণনার দিকে যেমন তাকিয়ে থাকবেন, তেমনি বিদেশের মাটিতেও অসংখ্য মানুষ নানা কারণে ভারতের নির্বাচনি ফলাফলের দিকে নজর রাখবেন।
‘বিশ্বরেকর্ডের ভোট’
ভারতের জাতীয় নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, দেশে এবারের লোকসভা নির্বাচন মোট ভোট পড়ার সংখ্যায় ‘সারা বিশ্বের সর্বকালের সব রেকর্ড’ ভেঙে দিয়েছে!
ভোটগণনার ঠিক আগে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করার রেওয়াজ না-থাকলেও সোমবার দুপুরে কিন্তু দিল্লির অশোকা রোডে কমিশনের সদর দফতরে ভারতের তিনজন নির্বাচন কমিশনারই সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
সেখানে দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার জানান, সাত দফা মিলিয়ে এবারের নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছে ৬৪ কোটি ২০ লক্ষেরও বেশি– যা একটি সর্বকালীন বিশ্বরেকর্ড। যদিও এবারের ভোটে দেশে মোট নথিভুক্ত ভোটার ছিলেন প্রায় ৯৭ কোটি।
রাজীব কুমার বলেন, “এটি আমাদের সবার জন্যই একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত!”
“সবগুলো জি-সেভেন দেশ মিলিয়ে যত ভোটার, এই সংখ্যা তার দেড় গুণ। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টা দেশ মিলিয়ে যত ভোটার, আমাদের সংখ্যা তার আড়াই গুণ! ফলে এই গণতন্ত্রের উৎসবে যারাই যোগ দিয়েছেন তাদের সবাইকে আমাদের ধন্যবাদ।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভারতের নির্বাচনকে একটি ‘মিরাকল’ বা অলৌকিক ঘটনা বলেও বর্ণনা করেন। তার কথায় “সারা বিশ্বে এর কোনও তুলনাই নেই!”
নির্বাচন কমিশন আরও জানিয়েছে, মঙ্গলবার ভোটগণনার সর্বশেষ ‘ট্রেন্ড’ ও ফলাফল জানা যাবে তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ।
এছাড়া মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের জন্য ‘ভোটার হেল্পলাইন অ্যাপ’ নামে একটি বিশেষ অ্যাপও চালু করেছে তারা, যেটি গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপল প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করা যাবে। সবশেষ ফলাফলের গতিপ্রকৃতি মিলবে এই অ্যাপেও।
জয়রাম রমেশকে ঘিরে বিতর্ক
দেশে ভোট গণনার ঠিক আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিরুদ্ধে মারাত্মক এক অভিযোগ তুলে তীব্র বিতর্কে জড়িয়েছেন কংগ্রেস নেতা ও দলের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশ।
গত ১লা জুন ভোটগ্রহণ যখন প্রায় শেষের পথে, সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি পোস্ট করে মি. রমেশ অভিযোগ করেন বিদায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সারা দেশের জেলা প্রশাসক বা কালেক্টরদের না কি নিজে ফোন করে ‘ভয় দেখাচ্ছেন’।
দেশের প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসকরাই (ডিএম) ভোট গণনার সময় রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন এবং সার্বিক তদারকির দায়িত্বে থাকেন।
জয়রাম রমেশের ইঙ্গিত ছিল, অমিত শাহ নিজে এই ডিএম-দের ফোন করে হুমকি দিচ্ছেন যাতে গণনার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা যায়।
‘এক্স’ হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) তিনি লেখেন, “এখনও পর্যন্ত অমিত শাহ শ’দেড়েক ডিএম/কালেক্টরের সঙ্গে কথা বলেছেন। এটা নির্লজ্জ ভীতি প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়, যা থেকে বোঝা যায় বিজেপি (পরাজয় এড়ানোর জন্য) কতটা মরিয়া!”
“সরকারি কর্মকর্তাদের কোনওভাবেই চাপের মুখে নতি স্বীকার করা উচিত নয়। সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করাই তাদের দায়িত্ব। তাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে,” আরও মন্তব্য করেন জয়রাম রমেশ।
এই অভিযোগ আমলে নিয়ে ভারতের নির্বাচন কমিশন জয়রাম রমেশের কাছে জানতে চায়, এই বক্তব্যের স্বপক্ষে কী তথ্য বা সাক্ষ্যপ্রমাণ তার কাছে আছে।
কমিশনের বক্তব্য ছিল, তারা এরকম কোনও অভিযোগ পায়নি– কাজেই একটি জাতীয় দলের একজন সিনিয়র নেতা ভোট গণনার ঠিক আগে কীসের ভিত্তিতে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে এরকম মন্তব্য করছেন, সেটা তাদের জানা দরকার।
২রা জুন (রবিবার) সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে মি. রমেশকে তার জবাব পাঠাতে বলা হলেও তিনি নিজের অভিযোগের সমর্থনে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করার জন্য অতিরিক্ত সাত দিন সময় দাবি করেন।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন সোমবার জানিয়েছে, অতিরিক্ত সময় দেওয়ার দাবি মঞ্জুর করা হচ্ছে না – এবং সোমবার (৩রা জুন) সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই মি. রমেশকে সব সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করতে হবে।
এটাও জানানো হয়েছে, সেই জবাব না পেলে কমিশন ধরে নেবে যে জয়রাম রমেশের তোলা ওই অভিযোগের কোনও ভিত্তি নেই– এবং কমিশন তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে।
যেভাবে আজ ভোট গোনা হবে
ভারতে বিগত বহু বছর ধরেই লোকসভা নির্বাচনে সব কেন্দ্রেই ভোটগ্রহণ করা হয়ে থাকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের মাধ্যমে, এবারেও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি।
তবে নিজের কেন্দ্রের বাইরে কাজে নিযুক্ত সরকারি কর্মী বা সেনা সদস্যরা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান।
বছরকয়েক হলো নির্বাচন কমিশন অতি বয়স্ক নাগরিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সেখানে বসেই ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু করেছে, যাতে তাদের পোলিং বুথে আসার কষ্ট না করতে হয়। আর এগুলো সবই হলো পেপার ব্যালট, অর্থাৎ কাগজের ব্যালট।
যে কোনও গণনাকেন্দ্রে ভোট গণনা শুরু হয় প্রথমে এই পোস্টাল ও পেপার ব্যালটগুলো গোনার মাধ্যমে। তাতে কেন্দ্রভেদে আধঘণ্ট থেকে এক ঘণ্টাও সময় লেগে যেতে পারে।
ফলে সকাল আটটা থেকে ভোটগণনা শুরু হলেও ইভিএম গোনা শুরু হতে হতে প্রায় ন’টা বেজে যায় বেশিরভাগ কেন্দ্রেই।
প্রতি দফার ভোট শেষ হওয়ার পরই ইভিএমগুলো সিলগালা করে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে বিভিন্ন সংসদীয় কেন্দ্রের স্ট্রংরুমে রাখা হয়ে থাকে।
আজ গণনার দিন সকালে সেই ইভিএমগুলো স্ট্রংরুম থেকে বের করে গণনাকেন্দ্রে এনে সব অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীর প্রতিনিধিদের সামনে তার সিল ভাঙা হবে।
প্রতিটি ইভিএমের ‘কন্ট্রোল ইউনিট’ ভালো মতো সিল করা ছিল কি না, সঠিকভাবে কাজ করছে কি না- গণনা শুরু করার আগে তা বারবার ভালো করে পরীক্ষা করার কথা ও সব দলের প্রতিনিধিদের সম্মতি নিয়েই গোনার প্রক্রিয়া শুরু করার কথা।
প্রতিটি কেন্দ্রে গণনার প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করেন ‘কাউন্টিং সুপারভাইজর’ ও ‘কাউন্টিং অ্যাসিস্ট্যান্ট’রা– যাদের নিয়োগ করেন ওই সংসদীয় আসনের রিটার্নিং অফিসার।
ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিটে প্রত্যেক প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট এক এক করে দেখানো হতে থাকে।
এক দফায় ১৪টি ইভিএম পরপর গোনার পর এক একটি রাউন্ডের ফল ঘোষণা করা হয় এবং তারপর আরও ১৪টি ইভিএম গোনা শেষ হলে ঘোষিত হয় পরবর্তী রাউন্ডের ফল।
এইভাবে সব ইভিএম গোনা শেষ হলে ওই কেন্দ্রের রিটার্নিং অফিসার চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন এবং সব চেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীর হাতে নির্বাচন কমিশনের তরফে বিজয়ীর সার্টিফিকেট তুলে দেন।
ভোটগণনার প্রক্রিয়াকে বিতর্কমুক্ত রাখতে কমিশনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেখা গেছে ভারতের প্রায় সব নির্বাচনেই ইভিএম কমবেশি বিতর্কের মুখে পড়েছে।
পরাজিত দল বহু ক্ষেত্রেই অভিযোগ করে থাকে, ইভিএমে কারচুপি করা সম্ভব এবং তা করাও হয়েছে– যদিও ভারতের শীর্ষ আদালত আজ পর্যন্ত ইভিএমের ব্যবহার বন্ধ করার কোনও নির্দেশ দেয়নি।
বস্তুত ভারতের নির্বাচনি প্রক্রিয়া আর ইভিএম কার্যত সমার্থক হয়ে উঠেছে– যা অদূর ভবিষ্যতে পরিবর্তনের কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
সম্পাদক ও প্রকাশক: এম. দেলোয়ার হোসেন
অফিস: অফিস: রোম নং-৫, নীচতলা, ১৭-১৮, বাইন কোর্ট, হোয়াইটচ্যাপল, লন্ডন।
মোবাইল: ০৭৩৭৭-৯৫১৬৮১