চাকরি করব, না মাস্টার্স করব?

প্রকাশিত:রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪ ১১:০৬

চাকরি করব, না মাস্টার্স করব?

জীবনযাত্রা ডেস্ক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ইফফাত সারার যুক্তিটা সহজ। ‘বিভাগের অ্যালামনাইদের সঙ্গে আলাপ করেছি। অনেকে বলছেন, স্নাতকের পর বিরতি দিলে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ কমে যায়। চাকরি, সংসার সামলে তখন আর পড়ালেখায় ফিরতে ইচ্ছা করে না। তাই স্নাতক শেষে আমার বিশ্ববিদ্যালয়েই স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়ে যেতে চাই।’ ইফফাতের মতো অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে শুধু স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে চাকরির সুযোগ কম। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকলেই কেবল চাকরিদাতারা গুরুত্ব দেন।

সত্যিই কি তাই?
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক নাফিসা নাজীনের অবশ্য ভিন্নমত। তাঁর মতে, ‘ভবিষ্যতে যাঁরা গবেষণা করতে চান বা উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যেতে চান, তাঁরা মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে পারেন। যাঁরা চাকরি করতে আগ্রহী, তাঁরা সরাসরি চাকরির জন্য নিজেকে তৈরি করুন। চাকরির পাঁচ-ছয় বছর পর ইচ্ছা হলে আপনি যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজন বুঝে মাস্টার্স করতে পারবেন। এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষতাকেন্দ্রিক ও বিশেষায়িত বিষয়ে মাস্টার্সের সুযোগ আছে। সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্স বা সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতেও ক্লাস করার সুযোগ দিচ্ছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। সব শিক্ষার্থীরই আসলে হুজুগে মাস্টার্সের পথে পা রাখার প্রয়োজন নেই।’

চাকরি, না মাস্টার্স—আপনিও যদি এই দোটানায় থাকেন, তাহলে কোন কোন বিষয় আমলে নেবেন? কোন পথেই–বা পা বাড়াবেন?

চাকরি যখন গুরুত্বপূর্ণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) অধ্যাপক রিদওয়ানুল হক মনে করেন, স্নাতকের পরপর চাকরিতে ঢুকে পড়াই এখনকার ‘ট্রেন্ড’। সদ্য স্নাতকদের কাছে কর্মজীবনটাও ক্লাসরুমের মতোই। তাঁরা অনেক কিছু শেখার সুযোগ পান। নিজের ঘাটতিগুলো ধরতে পারেন। ক্লাসে শুধু তাত্ত্বিক পড়াশোনা হয়। অন্যদিকে কর্মজীবনে থাকে সেসব প্রয়োগের সুযোগ। তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর চাকরির অভিজ্ঞতা নিয়ে মাস্টার্সে পড়ার সুবিধা অনেক। মাস্টার্সে সাধারণত কোর্সগুলো বিশেষায়িত হয়। কর্মমুখী বা একক গবেষণাকেন্দ্রিক হয়। আমি মাঝেমধ্যেই ইউরোপ বা পশ্চিমের উন্নত দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও সেমিনারে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাই। সেখানে দেখেছি, পেশা খাতে বিশেষ দক্ষতা অর্জনের জন্য কলেজের পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষার্থীরা কারিগরি বিষয়ে ডিগ্রি নিতে বেশি আগ্রহী। যাঁরা ভবিষ্যতে গবেষণা বা শিক্ষকতায় যাবেন, তাঁরাই মাস্টার্স করে পিএইচডি করতে আগ্রহী হন। কেউ হয়তো বিবিএ পড়ে চাকরিতে ঢুকে পড়ছেন। পরে তিনি আবার ডেটা সায়েন্সে মাস্টার্স করছেন। পেশার চাহিদা অনুযায়ীই ইউরোপ-আমেরিকায় মাস্টার্স করার চল।’

থাইল্যান্ডের মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক হিসেবে যুক্ত আছেন নাদিম রেজা। তিনি বলেন, ‘স্নাতক ডিগ্রি শেষে আমাদের দেশে হুজুগে মাস্টার্স করার প্রবণতা আছে। আপনি যে বিষয়ে স্নাতক করেছেন, সে বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রির হয়তো প্রয়োজন নেই। স্নাতক শেষে কয়েক বছর চাকরি করে নিজের দক্ষতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে মাস্টার্স করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষে ইন্টার্নশিপ করার মাধ্যমে চাকরির অভিজ্ঞতা নিতে পারেন।’

যাঁরা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় আগ্রহী
২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পপুলেশন হেলথ সায়েন্সেসে মাস্টার্স করেছেন শাহরিয়ার আহমেদ। এখন একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থায় বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন। বলছিলেন, ‘আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জনের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হই। স্নাতকের পড়া শেষে মনে হয়েছিল মাস্টার্স ডিগ্রির প্রয়োজন আছে। পরে পেশাগত কাজের কারণে অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয়েছে। নবীন গবেষক হিসেবে গবেষণার সুযোগ পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ১১ বছর পরে আমি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার মাস্টার্সে ভর্তি হই। মাস্টার্স ডিগ্রি আসলে পেশাজীবনে দক্ষতাসংশ্লিষ্ট। আমরা যে পেশায় আছি, সেই পেশাসংশ্লিষ্ট মাস্টার্স ডিগ্রি চাকরিতে পদোন্নতি ও নতুন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। যাঁরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, কিন্তু জানেন না কোন পেশায় আসবেন বা কী করবেন, তাঁরা স্নাতকের পর স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়ে যেতে পারেন। বিরতি না নিয়ে একবারে স্নাতকোত্তর শেষ করে ফেলতে পারলে মন্দ হয় না।’

বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান চাকরির আবেদনের পূর্বশর্ত হিসেবেই ‘স্নাতকোত্তর’ ডিগ্রির কথা উল্লেখ করে দেয়। স্নাতকের পরপরই চাকরির আবেদন করতে গিয়ে তাই অনেকেই শুরুতে ধাক্কা খান। তবে যদি নানা রকম সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ততা থাকে, নেতৃত্ব দেওয়ার কিংবা খণ্ডকালীন কাজের অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি না থাকার ‘বাধা’ কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেকখানি। তাই স্নাতক শেষে আগে নিজেকেই প্রশ্ন করুন, চাকরির জন্য আপনি কি প্রস্তুত? নাকি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে সুযোগের পরিসরটা আরও বড় করতে চান?