হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে

প্রকাশিত:শনিবার, ০৬ জুলা ২০২৪ ১০:০৭

হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে

ভ্রমন ডেস্ক: গা পোড়ানো রোদ, অনেক রোদের মচ্ছব, রোদে রোদে যেন ঘুড়ির মতো কাটাকুটি খেলা চলে সেখানে—অনবরত। দিগন্তবিস্তৃত বালুর ওপর প্রতিফলিত হয়ে সূর্য হয়তো চিকচিক করে ওঠে। বালু আর সূর্য মিলে প্রকৃতিতে মুহূর্তেই যে চকমক করা সোনার গয়না তৈরি হয়, তা–ই কি চিলমারী—চিলমারীর বন্দর?

বন্দর মানে তো সেখানে জলের গল্পও থাকে, আসে সার সার নৌকা এবং নাওভরা মানুষজনের সুখ–দুঃখের ইতিবৃত্ত। চিলমারী বন্দরে ব্রহ্মপুত্র নদের ঢেউয়ে ঢেউয়ে কতশত গল্প ভেসে বেড়ায় রোদের মতো, সেসব গল্পেও চলে মারদাঙ্গা কাটাকুটি খেলা! কোনো একসময়, কালে কালে গল্পগুলো ইতিহাস হয়ে নেমে পড়ে স্থলে—বালুতে।

১৯৪৬ সাল। চিলমারী বাজারের তৎকালীন রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে সবে গানের আসরের ইতি টেনেছেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদ। বাদ্যযন্ত্র বাঁধাছাদা হচ্ছে। এ সময় তাঁর কাছে আবারও গান গাওয়ার জন্য মিনতি করলেন দুজন। বললেন, পায়ে হেঁটে অনেক দূর থেকে এসেছেন তাঁরা। আব্বাস উদ্দীন তাঁদের বললেন, ‘এবার তো সব গোছানো হয়ে গেছে। পরেরবার এলে আপনাদের গান শোনাব।’

তখন ওই দুই ব্যক্তির একজন বললেন, ‘স্যার, তত দিন যদি আমরা না বাঁচি।’

শেষমেশ মানুষ দুটোর আবেগের কাছে পরাস্ত হয়ে তাঁদের গান শুনিয়েছিলেন আব্বাস উদ্দীন। এই গল্প ইতিহাসের সত্য। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই… আর কি কব দুষ্কের জ্বালা গাড়িয়াল ভাই’—এমন ভাওয়াইয়া গীতসুধার রসে যাঁরা আকুল হন, তাঁরাই তো চিলমারীর মানুষ।

পাটভর্তি গরু–মহিষের গাড়িগুলো দেবে যাচ্ছে বালু–কাদায়, ক্লান্ত–শ্রান্ত এক গাড়িয়াল—‘কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে…’ বলে উদাস চোখে সেই গাড়িয়াল ভাই হয়তো উজানে যায়, পেছনে পড়ে থাকে তার বেড়ার ঘর, ঘরে হোগলা পাতার মতো তার একান্ত নারী; ওদিকে সবকিছু পেছন ফেলে গাড়িয়ালের সামনে তখন রাশি রাশি নৌকা–জাগা চিলমারীর বন্দর। বন্দরের উদ্দেশে বেরোনোর আগে ঘাড়ের গামছাটা কি বাড়িতে ফেলে এসেছে গাড়িয়াল? গাড়ি হাঁকিয়ে যে গাড়িয়াল চিলমারীর বন্দরে ছোটে, তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে দূর থেকে কেউ একজন হয়তো হাঁক দেয়, ‘কডই যান, বাহে?’

কল্পনায় চিলমারীর বন্দরের ছবিগুলো আমার কাছে ছিল এমনই। কারণ, বিভিন্ন বইপত্রে চিলমারী বন্দরের যে বিবরণ, তা এরূপ ছবি আঁকতেই প্ররোচিত করে। তা ছাড়া উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম জেলার একদম প্রান্তের এই বন্দর ঘিরে কাব্য–গান–গাথাও কম হয়নি। যুগে যুগে ব্রহ্মপুত্র নদের ঢেউয়ের সঙ্গে উত্তাল হয়েছে ‘বাহের দেশ’–এর মানুষের আবেগ। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই,/ হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে…’। আব্বাস উদ্দীনের এই গানের মধ্যে যেসব ছবি ঝকমক করে, মনশ্চক্ষে সেখানে দেখতে পাই, বালুময় প্রান্তরে চলছে একলা গাড়িয়াল। অদূরে ব্রহ্মপুত্রে নানা রঙের নৌকার পাল, ঢেউয়ের ছলাৎছল। তাই আমাদের সামষ্টিক মানসপটে চিলমারীর বন্দর মানে এক বিরহ–জাগানিয়া প্রান্তর। খানিকটা দারিদ্র্যপীড়িত, গরিবি রঙে আঁকাও কি নয়?

বলা ভালো, ব্রহ্মপুত্রের কারণেই মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে চিলমারীর বন্দর। ইতিহাসও এই বন্দরের প্রাচীনত্ব স্বীকার করে। চীন থেকে ভারতের পূর্ব দিকে আসামে প্রবেশ করে এরপর কুড়িগ্রামে পৌঁছেছে ব্রহ্মপুত্র। দশম শতাব্দীর আগে ব্রহ্মপুত্র নদের পথ বেয়ে উত্তর–পূর্ব ভারত ও চীনের মধ্যে যে নৌপথ ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল, আরব বণিকেরা সে সময় এই পথ দিয়ে তাঁদের পণ্য পরিবহন করতেন—এমন অনুমান ইতিহাসবিদদের। তবে এখন অব্দি চিলমারীসংক্রান্ত যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে, এই বন্দর প্রথমে মোগলদের একটি সীমান্তচৌকি এবং রণতরি নির্মাণের কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিল। আর সরকারিভাবে পয়লাবার চিলমারীর নাম পাওয়া যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে। ১৭৬৪ থেকে ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত নৌ–অধ্যক্ষ ও ভূগোলবিদ মেজর জেমস রেনেল যখন বাংলার প্রধান নদ–নদীগুলো জরিপ করে মানচিত্র তৈরি করেন, তখন ১৭৬৫ সালে রেনেলের করা মানচিত্রে পাওয়া যায় চিলমারীর নাম। সে সময় অবশ্য এ এলাকার নাম ছিল মরুয়ারদহ।

এই যে মরুয়ারদহ, দিনে দিনে সেটি চিলমারীর বন্দর হয়ে উঠল। ইতিহাস বলছে, গেল শতকের ত্রিশের দশকে জিতুর হাট বা পুরোনো চিলমারী ছিল বিকিকিনির মূল কেন্দ্র। বালু আর থিকথিকে কাদা ডিঙিয়ে গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রামের নানান এলাকা থেকে আসত পাটবোঝাই গরু-মহিষের গাড়ি। তারপর নৌকা বা জাহাজে চেপে সেই পাট পৌঁছে যেত কলকাতায়। ব্রিটিশ আমল থেকে বন্দর ঘিরে বাণিজ্যের প্রসার ঘটলেও এখানকার মানুষ ছিল প্রান্তিক ও নিরন্ন। তাদের অভাবঘেরা আকাশে রোদ উঠত বটে, তবে রোদটা বড়ই ক্ষণস্থায়ী, ভাঙনের মেঘ ওই রোদকে থিতু হতে দেয়নি কখনো। কেননা, ব্রহ্মপুত্রের একূল ভাঙা আর ওকূল গড়ার খেলায় বারবার নিঃস্ব হয়েছে চিলমারীর আমজনতা। গাড়িয়াল ভাইয়েরা তারপরও হাঁকিয়েছে গাড়ি। গানের ভাষায় বলে গেছে, ‘কত কাঁদিম্‌ মুই নিধুয়া–পাথারে!’

কখনো কখনো গাড়িয়ালদের ক্রন্দনের সেই সুর আমরাও কি শুনিনি? ‘মঙ্গা’ শব্দটি তো খুব বেশি দূরের ঘটনা নয় আমাদের জন্য। বৃহত্তর রংপুরে অভাবের অপর নামই ছিল মঙ্গা। যদিও মঙ্গাপীড়িত সেসব দিন এখন গত। কিন্তু এই নাগরিক জীবনে গাড়িয়াল ভাইদের দারিদ্র্যক্লিষ্ট অভাবের চেয়ে তাঁদের আবেগতাড়িত গানই বোধ করি আমাদের বেশি টেনেছে। কাব্য করে বলেছি, চিলমারীর বন্দর হলো ব্রহ্মপুত্র নদের পেটের পাশে বেড়ে ওঠা শিশু।

দিনকয়েক আগে মাঝহেমন্তের এক সকালে সেই বন্দরে যখন প্রথম পা দিলাম, কল্পনার আবেগ আর বাস্তবতার দ্বৈরথে চুরমার হয়ে গেল মনের অতলে থাকা ছবি। এখানে এখন মঙ্গা নেই। একই সঙ্গে পাটের কারবারসহ ‘নাই’ হয়ে গেছে অনেক কিছুই।

কোথায় সেই গরুর গাড়ি, গাড়িয়াল ভাই! গাড়িয়ালের প্রেয়সী কি আছে এখনো পন্থের দিকে চেয়ে?


চিলমারীর বন্দর দেখব বলে ঢাকা থেকে এক রাতে চেপে বসেছিলাম কুড়িগ্রামগামী বাসে। আমন্ত্রণটা এসেছিল কবি ও সংগঠক নাহিদ হাসানের তরফে। চিলমারীর সন্তান নাহিদ হাসানের ক্ষেত্রে ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ কথাটি বড়ই লাগসই। হ্যাঁ, মোষ তিনি যথেষ্টই তাড়ান। চিলমারীতে নদীভাঙন প্রতিরোধের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। এরপর কুড়িগ্রামে আন্তনগর ট্রেন চালুর দাবিতে আন্দোলন করলেন। ট্রেন চালু হলো। চালু হলো চিলমারী বন্দর এবং ফেরিও। এরপরও তাঁর কাজ থামেনি। এখন ‘রাষ্ট্রালাপ পাঠচক্র’ নামে একটি পাঠাগারের মাধ্যমে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের বই পড়ানোর আন্দোলন করছেন। পেশাজীবনে স্কুলশিক্ষক এই মানুষ চিলমারীর ভেতরের এক চরে মাস্টারি করেন। তিনি যখন আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, ‘ভাই, চলি আইসেন, সাহিত্য নিয়ে এখানকার তরুণ কবি–সাহিত্যিকদের কিছু কথা বইলবেন,’ তখন তো আর কথা থাকে না। তবে আমার দিক থেকে কথা বলাটা অসিলামাত্র, আসল বিষয় ছিল চিলমারী–দর্শন।

সেই চিলমারীর বন্দরে আমরা এলাম ইঞ্জিনচালিত অটোয় চেপে। কুড়িগ্রাম থেকে বন্দরটির দূরত্ব ১৮–১৯ মাইল। এই পুরো যাত্রাপথের দুপাশে চোখজুড়ানো ধানখেত, পাটখেত… একটু পরপর উঁকি দিচ্ছেন মান্যবর জলাশয় মহাশয়, কলাগাছগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বটে, কিন্তু সেই দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেও কেমন যেন এখানকার মানুষের মতো ‘অল্পে তুষ্ট’ থাকার একটা ব্যাপার রয়েছে, নইলে পত্রকুলসমেত গাছগুলো খানিকটা নতমুখী কেন!

মুঠোফোনের ইউটিউবে কখনো কখনো আমাদের সঙ্গ দিচ্ছেন আব্বাস উদ্দীনের কন্যা ফেরদৌসী রহমান:

‘ওরে গাড়িয়াল বন্ধু রে

বন্ধু ছাড়িয়া রইতে পারি না রে

বন্ধুর গাড়ির চাকায় ভরেয়া গান

আদিয়া আদিয়া চলিয়া যান রে

ওকি গাড়িয়াল বন্ধু রে।’

ট্র্যাজেডি হলো, গাড়িয়াল বন্ধুর জন্য যতই আমাদের আবেগ উথলে উঠুক না কেন, এখন চিলমারীর বন্দরে যেতে হয় অটো কিংবা বাসে। বাহের দেশে গরু–মহিষের গাড়ি আর গাড়িয়ালের লেশ বর্তমানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সবার হাতে ফেসবুক। এদের মধ্যে কারও কারও দৃষ্টিতে ঔৎসুক্য, ‘ভিনদেশি’ আমাকে দেখে হয়তো স্থানিক উচ্চারণে বলতে চান, ‘কডই থাকি আইসছেন?’


চিলমারীর বন্দরে দাঁড়িয়ে প্রথমেই মনে হলো, একটি জলরংচিত্রের মধ্যে যেন বাঁধা পড়ে গেছি আমি! সেই ছবির ক্যানভাসের ভেতর ব্রহ্মপুত্র ঘেঁষে ছোট–বড় নৌকার সারি। তার ওপর খাড়া হয়ে আছে যে ঝকঝকে আকাশ, তা–ও আলট্রামেরিন ব্লুতে ঠাসা—ঘন নীল। রোদ থাকলেও ফুরফুরে বাতাস আপনমনেই শুষে নিচ্ছে তার খানিকটা তেজ। চিলমারীর বন্দরের এই বিস্তৃত প্রাকৃতিক ক্যানভাস আনমনেই অসীমকে ছুঁতে চায়। আর এখানকার সহজ মানুষেরা কী করেন সেই ক্যানভাসের ভেতর?

বন্দরের পাশেই কয়েকটি দোকান ও হোটেল। সবকিছুই বালুর ওপর। সেখানে কেউ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন, কারও মনোযোগ ভাতের থালায়। কেউ বা ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে দূরের চরে যাবেন, তাকিয়ে আছেন ওপার থেকে এগিয়ে আসা নৌকার দিকে। সবকিছুই ধীরে বয় এখানে। মানুষেরা কথা বলেন ধীরে, তাদের সব কর্মকাণ্ডেই আছে ধীর লয়ের ছোঁয়া।

হোটেলে বসে সুড়ুৎ সুড়ুৎ শব্দে চা খাচ্ছিলেন মাহফুজুর রহমান নামের এক যুবক। নাহিদ ভাইয়ের দিকে চোখ পড়তেই তিনি বললেন, ‘কডই যান, মামা?’ এরপর তাকালেন আমাদের দিকে। তাঁর দৃষ্টির মর্ম বুঝতে পেরে নাহিদ ভাই বললেন, ‘ঢাকা থাকি আসিইছেন।’

খানিক বাদেই আমাদের সঙ্গে ভিড়ে গেলেন মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর করা মাহফুজ। নাহিদ ভাই, মাহফুজসহ আমাদের সঙ্গে আরও রয়েছেন তরুণ কবি এনাম রাজু। নৌকায় চেপে সবাই যাচ্ছি বান্ধালের চরে। নাহিদ ভাই জানালেন, বান্ধালের চরে ভুট্টার চাষ হয়, ‘চরে সবুজ কলাগাছের নিচে যখন বইসবেন, জান জুড়ি যাইবে।’

ব্রহ্মপুত্রের বুক চিরে কলের নৌকা চলছে। ছেলে–বুড়ো, ধান–চাল, গাছগাছালি, হাঁস–মুরগি—মিলেমিশে নৌকায় বেশ ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ দশা।

মুরব্বি গোছের একজন বসে আছেন সামনে। হালকা নীল পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা। মাথায় লাল গামছা, মুখে সফেদ দাড়ি। খেতের ফসল দেখতে তিনি যাবেন চরে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ফসলাদি যা পান, তাতে চলে, চাচা?’

প্রখর রোদ। রোদের মধ্যে মুরব্বির হাসি আরেকটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আল্লায় চালায়।’

মাহফুজ এতক্ষণ মুঠোফোনের ক্যামেরায় বিভিন্ন দৃশ্যের ছবি তুলছিলেন। হঠাৎ বুড়ো চাচার কথার সঙ্গে সংগত দিয়ে বলেন, ‘দিন যাওয়া নিয়ে অত ভাবিনে হামরা। মুই ঢাকাত এক কোম্পানিত চাকরি করছিনু। কিন্তু এই ব্রহ্মপুত্রের টানত থাইকপের পাং নাই (পারিনি)। হেডেই (এখানে) দেহেন না কেমন বাতাস! ঢাকাত নিকেশ আটকে যায় (নিশ্বাস আটকে যায়)। এই জইন্যে ক্যারিয়ারের আশা না করি চলি আইসছি।’

‘ক্যারিয়ার’ শব্দটি অবচেতনেই মাথার মধ্যে একটা ঠোকর দিল! চোখের সামনে ভেসে উঠল সফল হওয়ার জন্য ক্রমাগত আমাদের দৌড়ঝাঁপ। পাশে বসা নাহিদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। গুনগুন করে তিনি কি সুর ভাঁজছেন?

মনে পড়ল, ঢাকার ‘ক্যারিয়ার’ আর ‘সফল’ হওয়ার বাসনা লুটিয়ে দিয়ে প্রায় দুই দশক আগে নাহিদ ভাইও ফিরে এসেছিলেন চিলমারীতে। তাহলে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ‘ক্যারিয়ার’, ‘সাফল্য—এগুলো কি অত বড় বিষয় নয়?

একবাক্যে প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া শক্ত। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মিশলে বোধ হয় মালুম করা যায় যে বাংলাদেশের দরিদ্রতম জেলা কুড়িগ্রামের লোকেদের বস্তুগত চাহিদা এখনো অতটা তীব্র নয়, অল্প খেয়ে–পরেই এখানকার বেশির ভাগ পাবলিক খুশি। কুড়িগ্রাম থেকে আরেকটু প্রান্তবাসী চিলমারীর মানুষের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য কি আরও গভীর?

কথাগুলো যখন এনাম রাজুকে বললাম, কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক টানসমেত অনেকটা প্রমিত ভাষায় গলা খুললেন তরুণ কবি, ‘এখানে ভুঁইয়ের দাম কিন্তু মেলা।’

: নদীভাঙন এলাকায় জমির দাম বেশি কেন?

: বাহে, মানুষ সব সময় মাটির কাছে থাকতে চায়, যাই–ই হোক, মাটি ছাড়তে চায় না। তাই নদীতে ভিটেমাটি হারালেও পাশের কোনো স্থানে জমি কিনে মানুষগুলো আবার ঘর তোলে। এই জইন্যে এখানে ভুঁইয়ের দাম মেলা।

রাজু আমার দিকে তাকালেন। হয়তো আমার কাছ থেকে ফিরতি কোনো কথা আশা করছিলেন। কিন্তু আমি তখন ভাবছিলাম অন্য বিষয়, সহজভাবে কথাগুলো যে বলে গেলেন রাজু, এ কি শুধু কথা, নাকি এর ভেতরে আছে আপামর মানুষের প্রবৃত্তিগত অবস্থান, যেভাবে একসময় গান গাইত গাড়িয়াল ভাইয়েরা?

হায়! প্রতিনিয়ত উচ্চ থেকে উচ্চতর ‘নাগরিক’ হওয়ার নেশায় আমরা কি আমাদের ভিটেমাটি ছেড়ে আসিনি, আমাদের সেই প্রবৃত্তিগত অবস্থান খুইয়ে ফেলিনি কি আমরা!