রংপুরের এমপিরা আত্মগোপনে, দেখা মিলছে না পদধারীদেরও

প্রকাশিত:বুধবার, ০৭ আগ ২০২৪ ১০:০৮

রংপুরের এমপিরা আত্মগোপনে, দেখা মিলছে না পদধারীদেরও

ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সঙ্গে নিয়ে গেছেন তার ছোট বোন শেখ রেহানাকেও। বিদেশে পাড়ি দিয়ে জনরোষ থেকে শেখ হাসিনা ও তার পরিবার বাঁচলেও অভাবনীয় মহাবিপদে পড়েছেন তার সরকারে থাকা এমপি-মন্ত্রীসহ দলীয় নেতাকর্মীরা।

শেখ হাসিনার পলায়নের পর চলমান পরিস্থিতিতে বিভাগীয় জেলা রংপুরেও টানা ১৬ বছর ক্ষমতার দাম্ভিকতায় থাকা আলোচিত নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। অভিভাবকশূন্য সংকটময় এ দিনগুলোতে বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তাদের কর্মী-সমর্থকরা। মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সারাদিন দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।

সবশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদে রংপুর জেলার সংসদীয় ছয়টি আসনের পাঁচটিতেই আধিপত্য ছিল আওয়ামী লীগের। এখানকার রংপুর-১ (গংগাচড়া ও আংশিক সিটি কর্পোরেশন) আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন আসাদুজ্জামান বাবলু, রংপুর-২ (বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ) আসনে আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক, রংপুর-৪ (পীরগাছা ও কাউনিয়া) আসনে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনে জাকির হোসেন সরকার, রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনে শিরীন শারমিন চৌধুরী। আর রংপুর-৩ (সদর ও সিটি) আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এ ছাড়াও সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য নাছিমা জামান ববি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং চলমান পরিস্থিতিতে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন রংপুরের সদ্য সাবেক এমপিরা। পাশাপাশি আত্মগোপনে রয়েছেন দলের ছোট-বড় সব নেতাকর্মী।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আত্মগোপনে চলে গেছেন রংপুর-১ আসনের সবশেষ সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান বাবলু। তিনি আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত ৪ আগস্ট তাকে গংগাচড়ায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে দেখা যায়। ওইদিন তিনি আন্দোলনকারীদের হাতে লাঞ্ছিত হন। এরপর প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এখন পর্যন্ত তার অবস্থান নিশ্চিত হতে পারেনি স্থানীয় কর্মীরা। শুধু বাবলুই নয় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিনসহ আওয়ামী লীগের দলীয় অনেক নেতাই এখন আড়ালে চলে গেছেন। গংগাচড়ায় বড় ধরনের কোনো সহিংসতা না ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটেনি। তবে দু-একজনের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে।

এদিকে রংপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক তিনিও লাপাত্তা রয়েছেন। আওয়ামী যুবলীগের এই প্রেসিডিয়াম সদস্য আত্মগোপনে থাকলেও তিনি এখন পর্যন্ত নিজের নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করছেন। তিনি নিরাপদে রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে তিনি ঠিক কোন জায়গায় অবস্থান করছেন তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিন দফায় ডিউক চৌধুরীর বাসায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে মালামাল লুট করা হয়। এ ছাড়াও উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বী সুইট, পৌর মেয়র টুটুল চৌধুরী, সাবেক মেয়র উত্তম কুমার সাহা, উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক পলিন চৌধুরীসহ সান্টু চৌধুরী ও লিটন চৌধুরীর বাসাবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনে। এ ঘটনার পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠনের দলীয় পদধারী নেতারাও।

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও নেই তার সংসদীয় এলাকায়। শেখ হাসিনার পলায়নে তিনি এখন কোথায় রয়েছেন জানে না স্থানীয় নেতারা। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, টিপু মুনশি ঢাকায় রয়েছেন। বিক্ষুব্ধ জনতা তার নগরীর বাসায় হামলা ও ভাঙচুর করেছেন। রংপুর-৫ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য জাকির হোসেন সরকারও নিরাপদ স্থানে রয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত তাকে মাঠে দেখেননি তার কর্মী-সমর্থকরা। এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এইচ এন আশিকুর রহমানের বাড়িতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

অন্যদিকে রংপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য ও সদ্য বিলুপ্ত সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী স্থানীয় না হওয়ায় পীরগঞ্জে তেমন বড় ধরনের কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। সরকার পতনের দিনে শেখ হাসিনার শ্বশুরবাড়ি হিসেবে পরিচিত পীরগঞ্জে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে। পীরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে থাকা বেশ কিছু মোটরসাইকেলও আগুনে পুড়ে গেছে।

এদিকে রংপুরের কাউনিয়াতেও উত্তেজিত জনতা সেখানকার উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুল ইসলাম মায়ার বাসায় হামলা চালায় এবং ভাঙচুর করে। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটায়।

শুধু সংসদ সদস্যরাই আত্মগোপন করেছে, এমনটা নয়। রংপুর মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা এবং অঙ্গসংগঠনের সবাই আত্মগোপনে রয়েছেন। এখন দলীয় নেতাকর্মীদের বেশির ভাগই অবস্থান পরিবর্তন করার পাশাপাশি বন্ধ রেখেছে মুঠোফোন নম্বর। এ কারণে দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এদিকে আওয়ামী লীগের সংকটময় এই দুর্দিনে তাদের কর্মী-সমর্থকরাও যোগাযোগ করতে পারছেন না নেতাদের সঙ্গে। এতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা। যদিও রংপুরে এখন পর্যন্ত কোনো কর্মী-সমর্থকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেনি।

নাম না প্রকাশের শর্তে অনেকেই বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি তৃণমূলের কর্মীদের এতদিন যে আস্থা ছিল, তা এখন আর নেই। তাদের কেউই নাকি কল্পনা করতে পারেননি শেখ হাসিনা এভাবে দেশত্যাগ করবেন। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মনোবল ভেঙে গেছে। একইসঙ্গে শেখ হাসিনা যে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন সেটাও কেউ কোনোদিন কল্পনা করেনি বলে মনে করছেন।