স্কুল-কলেজ খুলছে, উপাচার্য নিয়ে সমস্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষাক্রমের কী হবে

প্রকাশিত:শুক্রবার, ১৬ আগ ২০২৪ ০২:০৮

স্কুল-কলেজ খুলছে, উপাচার্য নিয়ে সমস্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষাক্রমের কী হবে

প্রায় এক মাসের অচলাবস্থা কাটিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আগামী রোববার থেকে খুলে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোও পুরোদমে চালুর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো নতুন সময়সূচি অনুযায়ী আগামী ১১ সেপ্টেম্বর শুরু হবে।

তবে সরকার পরিবর্তনের পর সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য, সহ–উপাচার্যসহ শীর্ষ পর্যায়ের পদগুলোতে পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো যোগ্য কাউকে নিয়োগ না দেওয়ায় প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দিয়েছে।

শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রায় এক মাস বন্ধ থাকায় এমনিতেই শিক্ষায় বড় রকম ক্ষতি হয়েছে। এখন শিক্ষাঙ্গনকে খুব দ্রুত কার্যকর করে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা উচিত। একই সঙ্গে দলীয়করণের বৃত্ত থেকে বের হয়ে পদত্যাগ করা পদগুলোতে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে।

এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা কমিটিগুলো নিয়েও জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এসব পরিচালনা কমিটি কার্যত প্রতিষ্ঠানের খুব একটা উপকারে আসেনি; বরং এসব কমিটির বিরুদ্ধে নানা সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সে ক্ষেত্রে সরকারি স্কুল-কলেজের মতো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পরিচালনা কমিটি ব্যবস্থা বাদ দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের কারণে গত ১৭ জুলাই থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পদত্যাগের হিড়িক পড়ে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, এখন পর্যন্ত ১৯ জন উপাচার্য, ১১ জন সহ–উপাচার্য এবং ৫ জন কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে ১৬ জনের পদত্যাগপত্র ইতিমধ্যে গৃহীত হয়েছে। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন আছে। দেশে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে ৫৫টি।

পদত্যাগ করা উপাচার্যদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মো. নূরুল আলম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মো. আবু তাহের, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সাদেকা হালিম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মশিউর রহমান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক এমদাদুল হক চৌধুরী প্রমুখ।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহও পদত্যাগ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশ কয়েকজন সহ–উপাচার্য, বিভিন্ন আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষ, রেজিস্ট্রার ও ছাত্র উপদেষ্টা, প্রক্টরদেরও কেউ কেউ পদত্যাগ করেছেন। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও পদত্যাগ করতে পারেন বলে আলোচনা আছে।

প্রশাসনিক এসব পদে নতুনদের নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এখন বৈধ শিক্ষার্থীদের হলে ওঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। সব শিক্ষার্থী হলে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পরিবেশ তৈরি হলেই ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া শুরু হবে।

খুলছে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা
আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর ৭ আগস্ট থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও স্কুলগুলোতে ভয় ও আতঙ্কে উপস্থিতি ছিল হাতে গোনা। গতকাল বৃহস্পতিবার মতিঝিলে অবস্থিত আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষক জানান, তাঁদের বিদ্যালয়ে একেকটি ক্লাসে শিক্ষার্থী ৬০ থেকে ৭০ জন। সেখানে গতকাল উপস্থিত ছিল ১২ থেকে ১৪ জন।

ঢাকার হাজারীবাগের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৩০০। গতকাল উপস্থিত ছিল ১০০-র মতো।

এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আগামী রোববার থেকে খুলে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার বিষয়ে নতুন করে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। গতকাল জারি করা এই নির্দেশনায় বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে গত বুধবার এক আদেশে পুরোদমে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খুলে শ্রেণি কার্যক্রম চালুর নির্দেশ দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

দুই মাস বিরতি দিয়ে এইচএসসি
এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো নতুন সময়সূচি অনুযায়ী আগামী ১১ সেপ্টেম্বর শুরু হচ্ছে। এ বিষয়ে গতকাল সংশোধিত সময়সূচি প্রকাশ করেছে শিক্ষা বোর্ড। শিক্ষার্থী আন্দোলনের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কয়েক দফায় এসব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ৮ দিন পরীক্ষা হয়েছে। এখনো আরও ১৩ দিনের পরীক্ষা বাকি আছে।

ষাণ্মাসিক পরীক্ষা আটকে আছে
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, গত ৩ জুলাই থেকে সারা দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন বা প্রচলিত অর্থে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে এক কোটির মতো শিক্ষার্থী এই মূল্যায়ন কার্যক্রমে অংশ নেয়। মোট ১০ বিষয়ে ১০ দিনে মূল্যায়ন কার্যক্রম হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চার দিন মূল্যায়ন কার্যক্রম হওয়ার পর তা আটকে যায়।

ঢাকার একটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এই মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এখন বিগত সরকার আমলের এই শিক্ষাক্রম দিয়ে মূল্যায়ন পরীক্ষা হবে কি না, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।

শিক্ষাক্রমের কী হবে
গত বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতেও চালু হয়েছে এ শিক্ষাক্রম। ২০২৭ সালে এটা দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু হবে। এ বছর যারা নবম শ্রেণিতে পড়ছে, তারাই নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রথমবারের মতো এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে হতে পারে এ পরীক্ষা। নতুন শিক্ষাক্রমে শিখন ও মূল্যায়নে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু এই শিক্ষাক্রম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক আছে। সরকার পরিবর্তনের পর এখন এই শিক্ষাক্রমের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কতগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হবে। দলীয় পরিচালনা কমিটিগুলো রেখে কতখানি স্বাভাবিক রাখা যাবে, সেটি ভেবে দেখতে হবে। আবার সংস্কারের ক্ষেত্রেও কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জেএসসির মতো পরীক্ষার বোঝা যেন আবার না আসে। শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী হতে পারে, কিন্তু পরীক্ষার বোঝা যেন না ঢোকে।

রাশেদা কে চৌধূরী মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ হয়তো একটি প্রক্রিয়ার বিষয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সচল রাখার জন্য অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ