আকস্মিক বন্যা, তবুও পানি সরতে এত দেরি কেন

প্রকাশিত:রবিবার, ২৫ আগ ২০২৪ ০৭:০৮

আকস্মিক বন্যা, তবুও পানি সরতে এত দেরি কেন

বন্যার পানিতে খামার থেকে ভেসে গেছে মুরগি। দুই–একটি যা উদ্ধার করতে পেরেছেন তা নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন এই ব্যক্তি। গতকাল দুপুরে ফেনী সাউথ ইস্ট ডিগ্রি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রের কাছেছবি: জুয়েল শীল
আকস্মিক বন্যার ধরনই হচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে প্রবল পানির তোড়ে এলাকা ভেসে যায়। আবার তা দ্রুত নেমেও যায়। এতে সাময়িক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দ্রুত পানি চলে যাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে না। কিন্তু এবার দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্তত ১১ জেলায় যে বন্যা হচ্ছে, তাতে পানি দ্রুত নামছে না।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শনিবার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বন্যা উপদ্রুত এলাকায় গড়ে ১৫ সেন্টিমিটার পানি কমেছে।

কেন্দ্রটির নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পানি কমার এই হারকে ধীর থেকে মাঝারি বলা যায়। তবে অন্যান্যবারের আকস্মিক বন্যার তুলনায় এবার পানি কমার হার কম।’

আকস্মিক এই বন্যা এবং পানি সরতে সময় বেশি লেগে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বন্যা উপদ্রুত এলাকার ছয় নদ-নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল।

নদ-নদীগুলো হলো কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, গোমতী, মুহুরি ও ফেনী। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ফেনী নদীর পানি রামগড় পয়েন্টে বয়ে যাচ্ছিল বিপৎসীমার ৯২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। আর মনু নদের পানি মৌলভীবাজার পয়েন্টে ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল।

এবারের বন্যায় যে ১১টি জেলা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে, তার মধ্যে একটি ফেনী। বন্যায় পুরো ফেনী শহর জলমগ্ন হয়ে পড়ে।

পাউবোর সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও বেসরকারি জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ম ইনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ফেনীর সোনাগাজীতে ফেনী নদীর বাঁধের যে রেগুলেটর আছে, সেখানকার ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার ভাটিতে চর পড়ে গেছে। এ ছাড়া ফেনী নদীও বেশ সংকীর্ণ। সাগরে পানি যাওয়ার পথও সংকীর্ণ। এ কারণেই এখানে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন এখনকার রেগুলেটরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে আরও ভাটিতে নতুন করে তা করতে হতে পারে। এসব নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নতুন করে ভাবতে হবে।

ছবি: বন্যার পানিতে পড়ে হাত ভেঙে যায় ছয় বছর বয়সী তাবাসুনের। মা ও মামার সঙ্গে হাসপাতালে যাচ্ছে সে। গতকাল দুপুরে ফেনীর ফাজিলপুর রেলস্টেশন এলাকায়


কুমিল্লায় বন্যা হলে পানি নামার পথ গোমতী নদী। এই নদী অনেকটাই ভরে গেছে। আর সে কারণেই পানি সরতে অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে করেন ম ইনামুল হক।

বর্ষা মৌসুমের পর শরতে এসে আকস্মিক বন্যার মুখে পড়ল দেশের এই বিশাল এলাকা। ১৭ ও ১৮ আগস্ট থেকে বঙ্গোপসাগর এবং এর পশ্চিম উপকূলে মৌসুমি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। লঘুচাপ টানা দুই দিন সেখানে অবস্থান করে। সেসময় দেশের উপকূল ও দক্ষিণ-পূর্বের পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টিপাত হয়। নদ-নদীর পানি এরপরই বাড়তে থাকে।

পূর্বাভাস ছিল, লঘুচাপটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বিহারের দিকে যাবে। কিন্তু লঘুচাপ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে লঘুচাপটি দেশের মধ্যাঞ্চলে থেকে যায়। লঘুচাপটি থাকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত। সে সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। ২০ আগস্ট রাতে ভারী বৃষ্টি হয়। এতেই আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, মৌসুমি লঘুচাপের কারণে সাগরে স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু জোয়ারের সৃষ্টি হয়। ১৯ আগস্ট ছিল পূর্ণিমা তিথি। এর ফলে সাগরে জোয়ার আরও বেড়ে যায়। এতে নদ-নদীর পানিনিষ্কাশনের যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তা বাধাগ্রস্ত হয়। এর সম্মিলিত প্রভাবে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরে একটি চরম অবস্থার সৃষ্টি হয়। পানি দীর্ঘ সময় ধরে থাকার এটাও একটি কারণ।

পূর্ণিমায় যে প্রবল জোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে, এর ফলে সাগরে পানি নেমে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থা আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত থাকতে পারে বলে জানান দুর্যোগবিশেষজ্ঞ গওহার নাইম ওয়ারা।

ছবি: বন্যায় পানিবন্দী এক নারীর হাতে ত্রাণ তুলে দেওয়া হচ্ছে। গতকাল দুপরে নোয়াখালী সদর উপজেলার কাদিরহানিফ ইউনিয়নের নিত্যনন্দপুর গ্রামে


দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় জুলাই মাসে। এবার এ মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বন্যা উপদ্রুত অনেক এলাকায় এবার যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা ইতিমধ্যে জুলাই মাসের গড় বৃষ্টির চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ ছাড়িয়ে গেছে। এ সময় উপদ্রুত অঞ্চলে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ।

বজলুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ফেনীতে ২৪ ঘণ্টায় ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টির অতীত রেকর্ড আছে। এবার ১ দিনে ৩১২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে এটা স্বাভাবিক নয়। বৃষ্টি ও উজানের ঢল এসে প্লাবিত হয়েছে বিপুল এলাকা। হাওরে পানি সরে যাওয়ার পথ আছে। কিন্তু ফেনী বা কুমিল্লায় সেই পথ নেই। এসব এলাকায় আগে এমন বন্যার রেকর্ডও নেই।

এ বিষয়ে গওহার নাইম ওয়ারা বলেন, ফেনী, কুমিল্লার মতো শহরগুলোয় পানিনিষ্কাশনের কার্যকর পথ নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলেই এমনটা হয়েছে। এটা শুধু এই দুটি শহরের ক্ষেত্রে নয়, দেশের সব শহরেরই প্রায় একই রকম অবস্থা। নগরীর নর্দমাগুলোতে এমন কোনো বস্তু নেই, যা মানুষ ফেলে না। এতে পানি সরতে আরও বিঘ্ন ঘটে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাশাপাশি অতিবৃষ্টি হয়েছে উজানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। সেখান থেকে পানি এত দ্রুত নেমে এসেছে যে সেটা অনুমানের বাইরে ছিল—এমনটাই মন্তব্য সরদার উদয় রায়হানের। তাঁর মতে, দ্রুত আসা পানি শুধু নদীতে নয়, প্লাবনভূমিতেও ছড়িয়ে আছে। সেসব প্লাবনভূমি থেকে পানি সরতে সময় লাগছে।