ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটে রাজনীতির ‘অনুপ্রবেশ’ যেভাবে

প্রকাশিত:মঙ্গলবার, ১৭ ডিসে ২০২৪ ০২:১২

ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটে রাজনীতির ‘অনুপ্রবেশ’ যেভাবে

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রোমাঞ্চকর ও জনপ্রিয় বেশ কিছু দ্বৈরথ আছে। তবে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া-ভারত, পাকিস্তান-আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে গেছে ভারত-পাকিস্তানের ঐতিহাসিক লড়াই। রাজনীতির অনুপ্রবেশ সেই আগুনে ঘি এবং রোমাঞ্চ দুটোই বাড়িয়ে দিয়েছে!

ক্রিকেটভক্তদের দরজায় কড়া নাড়ছে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০২৫। পাকিস্তানের তিনটি ভেন্যুতে আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ টুর্নামেন্টটির সম্ভাব্য দিনক্ষণ নির্ধারিত রয়েছে। তবে তার আগে বাগড়া দিয়েছে ভারত-পাকিস্তানের পুরোনো দ্বন্দ্ব। পাকিস্তানের মাটিতে গিয়ে ভারত খেলতে না চাওয়ায় শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্টটি ‘হাইব্রিড মডেলে’ই মাঠে গড়ানোর সম্ভাবনা প্রবল। ক্রিকেটীয় উত্তেজনা ছাড়িয়ে যখন দুটি দেশের রাজনৈতিক বৈরিতা এক্ষেত্রে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের প্রসবকালটাও তলিয়ে দেখা যেতে পারে।

ভারত-পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বৈরিতা অবশ্য সাম্প্রতিক কালের কোনো উদ্ভুত ঘটনা নয়। ব্রিটিশ উপনিবেশের ইতি ঘটতেই ১৯৪৭ সালে ঐতিহাসিকভাবে এই দুটি দেশের জন্ম। অর্থাৎ, জন্মলগ্ন থেকে বৈরিতা সঙ্গে করে পথচলা শুরু ভারত-পাকিস্তানের। এরপর তিন দফায় সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছে উপমহাদেশের দুই নামজাদা রাষ্ট্র।

ক্রিকেটে রাজনীতির থাবা
১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়া-উল-হক ভারতে দুই দলের টেস্ট দেখতে গিয়েছিলেন। তার আগেই দেশ দুটি কাশ্মির ইস্যুতে বিবাদমান ছিল। সেই উত্তেজনা বাড়তে থাকলে একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে বলে বসেন– পাকিস্তানের কাছে নিউক্লিয়ার বোমা আছে। ফলে দু’পক্ষের সম্পর্ক আবারও শীতলতায় রূপ নেয়!

দুই দেশ সেসব ভুলে ২০০৩–২০০৮ সময়কালে পাকিস্তানে দুটি ও ভারতে দুটি টেস্ট ম্যাচ খেলে। সম্ভবত সেটাই উভয় দেশের ক্রিকেটীয় কূটনীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ!

২০০৮ সালে সেই সম্পর্ক ধসে যায় সন্ত্রাসের কালো থাবায়। যখন পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ভারতের বৃহত্তম শহর মুম্বাইয়ের চারদিন ব্যাপী ভয়াবহ হামলায় ১৬০-১৭৫ জনকে হত্যা করে। এরপরই কূটনীতির পাশাপাশি দুই দেশের ক্রিকেটীয় সম্পর্কের দরজাও বন্ধ হয়ে যায়। আর তাতে আগুন জোগানোর কাজটা করে যাচ্ছে কাশ্মির ইস্যু! একই সময়ে শাসকদের মতো পাল্টাপাল্টি মন্তব্যে উত্তাপ বাড়িয়েছেন দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ড প্রধানরাও।

দুই দেশের মাঝে সেতুবন্ধনে ফাটল ধরার বিষয়টি পাকিস্তানি সাংবাদিক ও ইএসপিএন ক্রিকইনফোর সাবেক সিনিয়র এডিটর ওসমান সামিউদ্দিন বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘যখন ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে ভালো সম্পর্ক ছিল, তখন দু’পক্ষের যেকোনো বিনিময়ের প্রধান বাহন ছিল ক্রিকেট। আবার যখন সেই সম্পর্ক অনুপস্থিত, সেই সময় ক্রিকেট কিংবা খেলা বর্জনই নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের উৎসে পরিণত হয়েছে।’

‘ভারত-পাকিস্তানের নেতারা কোনো কারণেই যখন-তখন সাক্ষাতে মিলিত হন না এবং কখনও উভয়পক্ষ মুখোমুখি হলে ক্রিকেটই হয় তাদের ভাব-প্রকাশের ভাষা। আবার এটিও ঠিক যে, কোনো কূটনীতিক বিষয়ও সবার আগে রাজনৈতিকভাবে অনুমোদন পেতে হয়’, এমনটাই বলছেন ‘দ্য আনকোয়াইট ওয়ান– এ হিস্টরি অব পাকিস্তান ক্রিকেট’ বইয়ের লেখক সামিউদ্দিন।

আশ্চর্য ঠেকলেও সত্যি– এখনই ভারতের কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া বিরাট কোহলি ১২০টি টেস্ট খেলে ফেললেও, ফরম্যাটটিতে কখনোই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের মোকাবিলা করার সৌভাগ্য হয়নি। পাকিস্তানের বড় তারকা বাবর আজমের এমন সুযোগ মেলা আরও দুঃসাধ্য। কারণ কোহলির আরও ৫ বছর পর টেস্টে অভিষেক হয়েছে তার। ফলে কপিল দেব–ইমরান খান কিংবা শচীন টেন্ডুলকার-শোয়েব আখতারের মতো নতুন কোনো লিজেন্ডারি দ্বৈরথ থেকে বঞ্চিত হয়েছে ক্রিকেটবিশ্ব।

দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বন্ধ এক যুগ
রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ দ্বিপাক্ষিক সিরিজ থেকে বিরত রয়েছে প্রায় এক যুগ। ২০১২ সালে পাকিস্তান ভারতের মাটিতে একটি ওয়ানডে সিরিজ খেললেও ২০০৫-০৬ মৌসুমের পর ভারত আর কখনোই পাকিস্তানে যায়নি। ২০১২ সালে ভারতে হওয়া সেই তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ২-১ ব্যবধানে জিতেছিল পাকিস্তান। এরপর বেশ কয়েকবার দ্বিপাক্ষিক সিরিজের সম্ভাবনা তৈরি হলেও আলোর মুখ দেখেনি।

দুই দলের ম্যাচ দেখতে চেয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে আইসিসি ও এসিসি আয়োজিত টুর্নামেন্টের জন্য। তাতেও ঝামেলা বেধেছে ২০২৩ এশিয়া কাপ থেকে। পাকিস্তান একক আয়োজক থাকলেও, ভারতের ইচ্ছায় টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয় ‘হাইব্রিড’ মডেলে। ফলে এশিয়া কাপ আয়োজনের পূর্ণ ফায়দা তুলতে ব্যর্থ পাকিস্তানে হয় ৬ ম্যাচ, বাকি ৯ ম্যাচ গড়ায় শ্রীলঙ্কায়। এটি ছিল পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আয়োজকের ভূমিকা।

অন্যদিকে, ভারতে অনুষ্ঠিত ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে নির্দ্বিধায় অংশ নিয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু ভারতের বেলায় সেই দৃশ্য আর থাকছে না। তারা পাকিস্তানে নিরাপত্তা হুমকির অজুহাত দিয়ে চলেছে লম্বা সময় ধরে। অবশ্য তার কারণও রয়েছে। ২০০৯ সালে পাকিস্তানে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে গিয়ে টিম বাসে হামলার শিকার হন লঙ্কান ক্রিকেটাররা। এরপর ছয় বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বন্ধ ছিল পাকিস্তানে।

২০১৫ সাল থেকে ফের পাকিস্তানে ক্রিকেট ফেরার পর অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডসহ প্রায় সব টেস্ট খেলুড়ে দেশ সফর করেছে। ব্যতিক্রম কেবল ভারত। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ তো দূরে থাক, আইসিসি কিংবা এসিসির ইভেন্টে অংশ নিতেও তারা পাকিস্তানে যেতে রাজি নয়। সম্প্রতি দৃষ্টিহীনদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও দেশটিতে দল পাঠায়নি বিসিসিআই।

ক্ষতির মুখে আইসিসি
ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ দেখতে ক্রিকেটবিশ্ব কতটা মুখিয়ে থাকে, সেটি সাম্প্রতিক টুর্নামেন্টগুলোতে নজর দিলেই টের পাওয়া যায়। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টেনে মুখোমুখি হয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল। সেই ম্যাচ সরাসরি উপভোগ করতে দর্শকরা মাত্র একদিনেই সব টিকিট কিনে নিয়েছিল।

এরপর গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপে আহমেদাবাদে হয়েছিল ভারত–পাকিস্তান রোমাঞ্চকর ম্যাচ। যাকে ঘিরে অভূতপূর্ব আগ্রহ তৈরি হয়েছিল দর্শকদের মাঝে। ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শক মাঠে বসে দেখেছেন সেই ম্যাচটি। যদিও পাকিস্তানি সমর্থকরা ভিসা জটিলতায় সেদিন মাঠে হাজির হতে পারেননি। তাতে কি! দর্শকরা ভেঙে দিয়েছেন অনলাইনে ম্যাচ দেখার রেকর্ড। ভারতের টিভি চ্যানেলগুলোয় খেলা দেখেছেন ১৭ কোটি ৩০ লাখ দর্শক, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দর্শক ছিল আরও বেশি, ২২ কোটি ৫০ লাখ।

কেবল তাই নয়, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ডিজনি প্লাস হটস্টারের দাবি– তাদের প্ল্যাটফর্মে সরাসরি খেলা দেখায় সবচেয়ে বেশি দর্শকের বিশ্বরেকর্ড গড়েছে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ। এ ছাড়া সর্বশেষ ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হয় নিউইয়র্কের নাসাউ স্টেডিয়ামে। সেই ম্যাচ দেখতে আবেদন জমা হয় ২০০ গুণেরও বেশি।

সবমিলিয়ে বোঝাই যায়– কেবল একটি দ্বৈরথকে ঘিরে কত উন্মাদনায় থাকে ক্রিকেটবিশ্ব। যার পেছনে রয়েছে আর্থিক হিসাবও। জানা গেছে, সম্প্রচারস্বত্ব ও পৃষ্ঠপোষক– এই দুই খাত থেকে আইসিসি সবচেয়ে বেশি আয় করে থাকে। ২০২৪ থেকে ২০২৭ চক্রে সম্প্রচারস্বত্ব থেকেই আইসিসির ৩২০ কোটি ডলার (৩৮ হাজার ২৫৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা) আসার কথা। এই সময়ে অন্যান্য খাত থেকে সংস্থাটি আরও ১০০ কোটি ডলার (১১ হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা) প্রত্যাশা করছে। আইসিসির বিপুল পরিমাণ আয়ের বড় উৎস ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ, যা ধারাবাহিকভাবে রেকর্ড দর্শক নিয়ে আসে এবং ক্রিকেটপ্রেমীদের আগ্রহ তুঙ্গে নিয়ে যায়।

আইসিসি কিংবা কোনো ক্রিকেট টুর্নামেন্ট যাতে ক্ষতির মুখে না পড়ে সে কারণে কিছুদিন আগেই ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) সভাপতি রিচার্ড গোল্ড বলেছিলেন, ‘যদি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারত কিংবা পাকিস্তান না খেলে, তাহলে সম্প্রচার স্বত্ব পাওয়া যাবে না এবং আমাদের সেটি বন্ধ করতে হবে।’ একইভাবে ভারত-পাকিস্তানের যে কেউ না থাকলে পৃষ্ঠপোষকও হারাতে পারে আইসিসি কিংবা আয়োজক দেশ।