৯ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
প্রকাশিত:সোমবার, ১০ জুন ২০২৪ ১০:০৬
নিউজ ডেস্ক: মোরশেদ মিয়া ব্যস্ত মানুষ। মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, কলেজে নিজের ক্লাস করছেন আবার গরুদের খাবার দিতে খামারে ছুটছেন। এর মধ্যে আছে তাঁর মঞ্চনাটক করার শখ। সম্প্রতি তিনি ফিরেছেন স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে একটি নাটকের কর্মশালা করে। কয়েক মাস আগে ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রশিক্ষণ কক্ষে মোরশেদ মিয়ার সঙ্গে প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল, তিনি কোনো চরিত্রের প্রয়োজনে পা ভাঁজ করে হাঁটু দিয়ে দৌড়াচ্ছেন। আসলে মোরশেদের জন্ম থেকেই দুই পা হাঁটুর নিচ থেকে এমন ভাঁজ করা।
২৫ বছরের মোরশেদ বললেন ‘শুধু দুই পা নেই বলে জীবনে এত তিক্ত অভিজ্ঞতা পেয়েছি। বিশ্বাস হয় না, মানুষের প্রতি মানুষ এত অসংবেদনশীল হতে পারে! কী শুনি নাই লুলা, ল্যাংড়া, খোঁড়া। খুব ছোটবেলায় আমি শব্দগুলা বুঝতেও পারতাম না। কিন্তু এটুকু বুঝতাম, আমি অন্যদের থেকে আলাদা।’
মোরশেদের জন্মের পর থেকে তাঁর অভাবী শ্রমজীবী বাবা মতিউর রহমান সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছেন ছেলের চিকিৎসা করাতে। মোরশেদের জন্মের পর কয়েক বছর পর্যন্ত হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছে পরিবারটি। সব চেষ্টা শেষ পর্যন্ত বিফল হয়।
এখন মোরশেদ মিয়ার হুইলচেয়ার থাকলেও একসময় তা ছিল না। তখন অভাবী পরিবারের এ সন্তানের হুইলচেয়ার ছিলেন তাঁর মা শিল্পী বেগম। মোরশেদ বললেন, সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত মা তাঁকে কোলে করে স্কুলে আনা-নেওয়া করতেন। প্রথম যখন তাঁকে স্কুলে ভর্তি করাতে নেওয়া হয়, সেখানে মোরশেদ ভর্তি হতে পারেননি। শিক্ষক বলেছিলেন, মোরশেদের আকৃতি দেখে শ্রেণিকক্ষের অন্য শিশুরা ভয় পাবে।
এরপর তাঁকে অন্য একটি স্কুলে ভর্তি করানো হয়। তবে দুর্ভোগ কমে না। একদিকে নিজের পঙ্গুজীবন, আরেক দিকে পরিবারের অভাব। মায়ের কোলে চড়ে স্কুলে আসা যাওয়ার পথে অনেকে টিপ্পনী কেটে বলতেন, ‘পঙ্গু ছেলেরে জজ–ব্যারিস্টার বানাইতে চায়।’ ছোট্ট মোরশেদ তখন মায়ের কাঁধে মুখ গুঁজে নিজের চোখের পানি লুকাতেন। আর তাঁর মা শিল্পী বেগম আঁচলে চোখ মুছতেন। এভাবে মানুষের সঙ্গে একরকম দূরত্ব তৈরি হয় মোরশেদের।
‘মাজারে নিয়া ফেইলা দিয়া আসেন’
শিশু মোরশেদ নিজের ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছিলেন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনায়। একবার বন্যায় তাঁদের বাড়িতে পানি উঠেছিল। তখন মোরশেদকে সুরক্ষিত রাখতে তাঁর নানাবাড়িতে রেখে আসা হয়। সেখানে রাতে মোরশেদ ঘুমাতেন একটা গরুর পাশে। ধীরে ধীরে সেই গরুর জন্য মায়া তৈরি হয়। বাড়ি ফেরার পর তাঁর বাবা তাঁকে একটি গরু কিনে দেন। এই গরুর খাবার জোগাড় করতে মাঠে ঘাস কাটতে যেতে হতো মোরশেদকে। মাটির কাছাকাছি উচ্চতার ছোট্ট মোরশেদের সারা গায়ে ময়লা, কাদা লেগে যেত। যেহেতু তখন দুই হাঁটুর সঙ্গে তাঁকে দুই হাতও ব্যবহার করতে হতো, তাই গরুর দড়ি অথবা ঘাস কাটার নিড়ানি থাকত তাঁর মুখে ধরা। গ্রামের মানুষ ওইভাবে মাটিতে তাঁর ছেঁচড়ে চলা দেখে কখনো কখনো উপহাস করে বলতেন, ‘ওই যে দুই গরু যায়।’
মোরশেদ বলেন, ‘এমনও হয়েছে যে কেউ কেউ বাড়িতে উপযাচক হয়ে এসে বলেছে, “ওরে মাজারে নিয়া ফেইলা দিয়া আসেন, ভিক্ষা করে খাক। এই প্রতিবন্ধী ছেলের বোঝা খামোখা টানতেছেন কেন।” এই কথা শুনে আমার মা নীরবে কাঁদতেন। কিন্তু আমাকে বড় স্বপ্ন দেখাইতেন। বলতেন, পড়ালেখা বাদ দেওয়া যাবে না। মানুষের কথায় কান দেওয়া যাবে না।’
ছোট্ট মোরশেদ তখন স্কুলেই যান অথবা গরুর জন্য ঘাস আনতে; মানুষের দিকে তাকাতেন না ভয়ে। মাঝেমধ্যে নিজের গরুটির সঙ্গে কথা বলতেন।
অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও মোরশেদ পড়ালেখা বন্ধ করেননি। ২০১৭ সালে তিনি এসএসসি ও ২০১৯ সালে এইচএসসি পাস করেছেন। দুটোতেই তাঁর ফল এ মাইনাস। বর্তমানে মোরশেদ মিয়া নারায়ণগঞ্জের নাজিমউদ্দিন ডিগ্রি কলেজ অ্যান্ড ইউনিভার্সিটির হিসাববিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন।
মোরশেদ প্রথম আলোকে জানান, তাঁর বাড়ি নরসিংদীর মাধবদী থেকে নারায়ণগঞ্জের ওই কলেজের দূরত্ব ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার। এই পথ তিনি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে যান। পথে দুবার তাঁকে অটোরিকশা বদলে নিতে হয়। মোরশেদ শিক্ষকতাও করেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বাহাদুরপুর মোল্লাবাদি এবতেদায়িয়া ফুরকানিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায়। এই মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষার্থীদের শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি পড়ান।
বাহাদুরপুর মোল্লাবাদি এবতেদায়িয়া ফুরকানিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ওবাইদুর রহমান আল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুরা মেঝেতে বসে পড়ে, এক ফুট উঁচুতে থাকে তাদের বই রাখার বেঞ্চ। মোরশেদ শ্রেণিকক্ষে হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন না। মেঝেতে হেঁটেই পাঠদান করেন। দেড় বছর ধরে অভিনব সব উপায়ে তিনি শিশুদের পাঠদান করছেন। এ জন্য শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে মোরশেদ একজন প্রিয় শিক্ষক।’
মোরশেদ মিয়ারা তিন ভাইবোন ছিলেন। তিনি সবার বড়। বোনের বিয়ে হয়েছে। তিনজনের মধ্যে সবার ছোট ভাই হামিদুল্লাহ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এখন মা–বাবাকে নিয়ে মোরশেদের তিন সদস্যের পরিবার। এই পুরো পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব মোরশেদের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এখন মাস শুরুর আগেই পুরো মাসের খরচ তুলে দিই বাবা–মায়ের হাতে। একটু একটু করে টাকাও জমাই বিপদ-আপদের জন্য। অনেক কিছু করি আমি। কিন্তু সবচেয়ে বড় অর্জন কী মনে হয় জানেন, আমার দিনমজুর বাবাকে একজন খামারি বানাতে পারা।’
মোরশেদের একটি ছোট্ট খামার আছে, যেখানে তিনটি গাভিসহ নয়টি গরু আছে। এখন মোরশেদের বাবা মতিউর রহমান আর দিনমজুর হিসেবে কাজে যান না। এই খামারের দেখাশোনা করেন।
নারায়ণগঞ্জের বাহাদুরাপুর গ্রামের বাসিন্দা শেখ সাদিকুর রহমান মোরশেদের বন্ধু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের নিয়ে মানুষ সব সময়ই অনেক আজেবাজে মন্তব্য করে। গ্রামের মানুষ আরও বেশি করে। মোরশেদও ছোটবেলায় মানুষের কথা শুনে অনেক কষ্ট পাইছে। কিন্তু সে প্রমাণ করে দিছে নিজেরে। আমার মনে হয়, এই নারায়ণগঞ্জ জেলায় আর একজন প্রতিবন্ধী মানুষ নাই, যার মোরশেদের মতো এত মনের শক্তি আছে।’
মোরশেদ মিয়ার মানসিক শক্তির আরেকটি অনন্য উদাহরণ পাওয়া গেল থিয়েটার নিয়ে তাঁর কাজ দেখে। ২০১৩ সাল থেকে নিজেকে যুক্ত করেছেন মঞ্চের সঙ্গে। হাঁটুতে ভর করে গণপরিবহনে চেপে তিনি রাজধানীতে আসেন। ঝড়বৃষ্টি যা–ই থাকুক, মোরশেদ দমে যান না। তিনি মঞ্চনাটকের বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নেন, নিজে অভিনয় করেন। দু-একটি নাটকে যৌথভাবে নির্দেশনার কাজও করেছেন।
থিয়েটারের কাজ নিয়ে ২০১৯ সালে মোরশেদ লন্ডনে যান। সেখানে ‘দ্য টেম্পেস্ট’ আর ‘স্বর্ণবোয়াল’ নাটক নিয়ে দুই সপ্তাহের কর্মশালা করেছেন। এর মধ্যে ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকটি প্রদর্শিত হয়েছে জাপানে অনুষ্ঠিত প্যারা অলিম্পিকে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে। চলতি বছরের এপ্রিলে মোরশেদ স্কটল্যান্ডে গিয়েছিলেন কর্মশালায় অংশ নিতে। সেখানে দলগতভাবে নির্মাণ করেছেন ‘বাস স্টপ’ নামের একটি নাটক। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি স্কটল্যান্ড থেকে ফিরেছেন।
ঢাকা থিয়েটার এর অভিনেতা এবং এর সহযোগী সংগঠন সুন্দরম এর নাট্য নির্দেশক ও প্রশিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মোরশেদের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে শেখার আগ্রহ। এ জন্য অনেক প্রতিবন্ধকতার পরও সে নিজেকে নাটকের মঞ্চে ভালো শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে পেরেছে।’ নরসিংদী থেকে এত বছর ধরে নিয়মিত ঢাকায় এসে মহড়া, প্রশিক্ষণ নেওয়া খুব সহজ না হলেও মোর্শেদ কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করছেন বলেন তিনি।
চলাচলে এত প্রতিবন্ধকতা নিয়েও মোরশেদের এগিয়ে যাওয়ার প্রাণশক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটবেলায় শুনেছি, আমাকে যেন মাজারে ভিক্ষা করতে রেখে আসা হয়। এ ছাড়া আমার আর কোনো ভবিষ্যৎ নাই। এখন সেই মানুষেরাই এসে আমার মাকে বলে, আপনার এই ছেলে পুরো পরিবারের খরচ চালায়। কেমনে সম্ভব! তখন আমার মায়ের চোখেমুখে যে তৃপ্তি দেখি, ওইটাই আমার চলার শক্তি।’
সম্পাদক ও প্রকাশক: এম. দেলোয়ার হোসেন
অফিস: অফিস: রোম নং-৫, নীচতলা, ১৭-১৮, বাইন কোর্ট, হোয়াইটচ্যাপল, লন্ডন।
মোবাইল: ০৭৩৭৭-৯৫১৬৮১