ফুটবলাদের বেতন-বোনাস বকেয়া, ভোট বাড়াতে অর্ধকোটির এজিএম

প্রকাশিত:শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪ ০১:০৬

ফুটবলাদের বেতন-বোনাস বকেয়া, ভোট বাড়াতে অর্ধকোটির এজিএম

ক্রীড়াঙ্গন ডেস্ক: বার্ষিক সাধারণ সভায় উপস্থিতিদের মধ্য থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত হবে। অধিকাংশ কাউন্সিলরশিপের পক্ষে মত দিলে ভোটাধিকার পাবে নারী লিগের ক্লাবগুলো, আর নাকচ হলে নেই। মানহীন লিগের চার দলকে কাউন্সিলরশিপ প্রদানের ব্যাপারে বাফুফের নির্বাহী সভায় তুমুল হট্টগোল হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে পাইওনিয়ার খেলে আসা ক্লাবগুলোর কোনো ভোটাধিকার নেই। এমনকি তৃতীয়-দ্বিতীয় বিভাগের সব ক্লাবও ভোটাধিকার পায় না। সেখানে বছরে মাত্র পাঁচ-ছয়টি ম্যাচ খেলে নারী লিগের চার ক্লাবের ভোটের অধিকার পাওয়া অত্যন্ত বৈষম্যমূলক। এ নিয়ে নির্বাহী কমিটির মতো সাধারণ কাউন্সিলরদের মধ্যেও রয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কাউন্সিলরদের অনেকে শীর্ষ দুই দলকে ভোটাধিকার প্রয়োগের পক্ষে এবং সেটা পরবর্তী নির্বাচনে বাস্তবায়ন চায়। যদিও বাফুফের কয়েকজন কর্তাদের মনোবাসনা– চারটি প্রস্তাব পাশ করিয়ে আসন্ন নির্বাচনে এর ফায়দা নেওয়া। এজন্য তাদের একাংশের কৌশল এই আলোচ্যসূচিতে মতামতের সুযোগ না দিয়ে সরাসরি হ্যাঁ-না ভোটে যাওয়ার।

বাফুফের শীর্ষ কর্তারা প্রায়ই আর্থিক অনটনের বুলি আওড়ান। আর্থিক টানাটানির মধ্যেই পাঁচ তারকা হোটেলে এজিএম করার পক্ষপাতী ছিলেন না অনেকেই। ভাড়া এড়াতে কেউ বাফুফে ভবনের মাঠেই এই আয়োজনের মত দিয়েছিলেন। নানা মত উপেক্ষা করে বাফুফে পাঁচ তারকা হোটেলেই এজিএম আয়োজন করছে। নির্বাচনী এজিএমে কাউন্সিলরদের আগেরদিন হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে ফেডারেশন। আবার অনেক কর্মকর্তা বিশেষ উপঢৌকনও দেন। নির্বাচনী এজিএম না হওয়ায় কাউন্সিলরদের তেমন সুযোগ-সুবিধা নেই।

ঠাকুরগাও, পঞ্চগড় ও কক্সবাজারের মতো দূর-দূরান্ত থেকে যারা আসবেন তারাও অন্য সবার মতো ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন। কাউন্সিলর/ডেলিগেট মিলিয়ে প্রায় ১৫০ জন, হোটেল ভাড়া ও আনুষঙ্গিক সবকিছু মিলিয়ে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার মতো খরচ হবে। অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী– ২০২২ সালের এজিএমে খরচ হয়েছিল প্রায় ৪০ লাখ টাকা। আগামীকালের এজিএম ব্যয়ও ওই রকমই হবে।

ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান কাজ ফুটবলারদের স্বার্থ রক্ষা করা। ফুটবল ফেডারেশনের মুখ রক্ষা করা নারী ফুটবলাররা এবার ঈদ করেছেন নিদারুণ কষ্টে। তিন মাসের বেশি সময় তারা ফেডারেশনের বেতন পান না। ফিফার সংকেত না পাওয়ায় বাফুফে নারীদের বেতন দিতে পারছে না। ফেডারেশনের অনেক অর্থশালী ব্যক্তিবর্গ থাকলেও ঈদের সময় নারী ফুটবলারদের মুখে হাসি ফোটাতে উদ্যোগী হননি। ঈদের পর আবার মেয়েরা ক্যাম্পে ফিরে অনুশীলন শুরু করেছে। অথচ এখনও কোনো অর্থকড়ি জোটেনি তাদের। পুরুষ ফুটবলারদের ৬০ লাখ বোনাসের প্রতিশ্রুতিও ফেডারেশন পূরণ করতে পারেনি। অথচ অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে এই এজিএম আয়োজন করছে।

দায়ের তালিকায় নেই জামালদের বোনাস, রেফারিদের কোটি টাকার সম্মানী নিয়েও অস্পষ্টতা
বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ২০২৩ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে প্রথম রাউন্ডের সময় জাতীয় দলের ফুটবলারদের জন্য ৬০ লাখ টাকা ঘোষণা করেছিলেন। সভাপতির সেই ঘোষণা নির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় আবার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়। ফেডারেশন ৬০ লাখ টাকা বোনাস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখনও সেটি পরিশোধ করতে পারেনি। ফুটবলারদের কাছে বাফুফে ৬০ লাখ টাকার দায় থাকলেও সেটি অডিট রিপোর্টে আসেনি।

ফুটবলাররা লিগ খেলে কাড়ি কাড়ি অর্থ আয় করেন, এরপরও জাতীয় দলে সেই অর্থে সাফল্য নেই। দীর্ঘদিন পর সাফ ফুটবলের সেমিফাইনালে যাওয়ায় ৫০ লাখ বোনাস ঘোষণা করেছিল তাদের জন্য। সেই বোনাস দেওয়ার মাস তিনেকের মধ্যে আবারও ৬০ লাখ টাকা বোনাস ঘোষণা করেন বাফুফে সভাপতি। একদিকে তিনি আর্থিক দুর্দশার কথা বলেন, অন্যদিকে উচ্চবিলাসী ঘোষণা দিয়ে ফেডারেশনকে রাখেন দায়ের মধ্যে।

২১ অক্টোবর সভায় ৬০ লাখ টাকা বোনাস ঘোষণার নানা যৌক্তিকতা তুলে ধরেন তিনি। এত যুক্তি তুলে ধরার আট মাস পেরিয়ে গেলেও সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। উল্টো খেলোয়াড়দের ক্যাম্প করলে ২৫ হাজার টাকা দিতেই এক মাসের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। ২০২৩ সালের অডিট রিপোর্টে দায়/পরিশোধযোগ্য হিসেবে ১৬৩ খাত/শিরোনাম রয়েছে। এর মধ্যে রেফারিদের বকেয়া নিয়ে কোনো খাতই নেই। রেফারিরা বিভিন্ন টুর্নামেন্ট বা প্রতিযোগিতার ম্যাচ পরিচালনা করে সম্মানী পান। সেই রকম প্রতিযোগিতা প্রিমিয়ার লিগ ২৩-২৪, ফেডারেশন কাপ, স্বাধীনতা কাপ সবমিলিয়েও ২০ লাখ হয় না। যদিও রেফারিদের তথ্যমতে– ২০২৩ পর্যন্ত তাদের বকেয়ার পরিমাণ অর্ধ কোটিরও বেশি।

২০২৩ সালে বাফুফের চলতি দায় ৯ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার ৩১৯ টাকা। এই দায়ের মধ্যে বাফুফের সাবেক সহ-সভাপতি তাবিথ আউয়ালের পাওনাই ২ কোটি টাকার ওপর। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাওনাদার বর্তমান সহ-সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদের ৮৪ লাখ। শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের মঞ্জুর কাদেরের পাওনা ৬২ লাখ। বাফুফের অধীনে চাকরি করা সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগও ফেডারেশনকে ধার দেন। ২০২৩ অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী তার পাওনা ৪ লাখ ২৮ হাজার।

চলতি দায় ছাড়াও বাফুফের ব্যাংক লোন এবং আনুষাঙ্গিক আরও দায় রয়েছে। ব্যাংক লোনের মধ্যে অন্যতম ২০১১ সালে আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচের জন্য আইএফআইসি ব্যাংকের ঋণ। ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় আইএফআইসি ব্যাংকের বোর্ড ব্যবহার করে বাফুফে সেই ঋণ কমিয়ে আনছে ধারাবাহিকভাবে।

বাফুফের বাজেটে নেই এনএসসি’র অনুদান, সম্ভাব্য স্পন্সর মাত্র ৫ কোটি
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের আয়ের সিংহভাগ ফিফা ও এএফসি’র অনুদান। এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন ৫ লাখ ও বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা বছরে বাফুফেকে ১২ লাখ ৫০ হাজার ডলার প্রদান করে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বর্তমান ডলার রেট ১১৭ টাকা হলেও বাফুফের সম্ভাব্য বাজেটে ১১০ টাকা ধরে এই দুই খাতে আয় দেখানো হয়েছে ১৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের সাবসিডিতে ৫ কোটি, দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (সাফ) থেকে বার্ষিক আয়ের পরিমাণ দেড় কোটি। এ ছাড়া জাপান ফুটবল এসোসিয়েশন বছরে ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করে বাফুফেকে।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) ক্রিকেট বাদে দেশের অন্য সকল ক্রীড়া ফেডারেশনকে বার্ষিক আর্থিক অনুদান প্রদান করে। বাফুফেই সর্বাধিক প্রায় ২৫ লাখ টাকার অনুদান পায় এনএসসি থেকে। নিয়মিত আয়ের খাত হলেও বাফুফের সম্ভাব্য বাজেটে এনএসসি’র আয় দেখানো হয়নি। জাপান ফুটবল এসোসিয়েশনের অনুদানের স্বীকৃতি দিলেও দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের এই বাজেট তালিকায় না থাকায়, ফেডারেশনের আর্থিক বিভাগের স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ফুটবলাঙ্গনে।

আন্তর্জাতিক ও সরকারি সহায়তার বাইরে বিশ্বের অনেক ফুটবল ফেডারেশনের আয়ের অন্যতম খাত স্পন্সর/পৃষ্ঠপোষকতা। বাফুফের খসড়া বাজেটে স্পন্সর খাতে সম্ভাব্য আয় মাত্র ৫ কোটি। স্পন্সরের পাশাপাশি গ্রাউন্ড-বিলবোর্ডও আয়ের একটি মাধ্যম। সেই খাতে বাফুফে ৫০ লাখ টাকা আয় ধরেছে। বাফুফের শীর্ষ অনেক কর্মকর্তা দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান চালান। এমন ব্যক্তিবর্গ থাকার পরেও ফুটবলে কর্পোরেটদের আকৃষ্ট করতে পারে না সেই অর্থে। মাঠের ফুটবলে ফলাফল যেমন নেই, এর চেয়েও বড় দায় আর্থিক অস্বচ্ছতা। যার কারণে খোদ ফিফা আর্থিক অসঙ্গতির জন্য স্টাফদের বহিষ্কার ও ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যানকে জরিমানা করেছে।

‘অন্যান্য’ ব্যয় সাড়ে তিন কোটি, ঘাটতি বাজেট ২৩ কোটি টাকার
২০২৪ সালের খসড়া বাজেটে বাফুফে ব্যয় নির্ধারণ করেছে ৫৪ কোটি ২৯ লাখ ৮৯ হাজার ৩০ টাকা। ব্যয়ের বিপরীতে আয় মাত্র ৩১ কোটি ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ফলে বাজেট ঘাটতি ২২ কোটি ৮০ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। বাফুফের বাজেট বরাবরই ঘাটতি-নির্ভর। স্বল্প ও সীমিত আয়ের সঠিক ব্যয় হয় না বাফুফেতে, তাই আরও বেশি ঘাটতি হয় বলে ধারণা ফুটবল সংশ্লিষ্টদের।

৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে ঘরোয়া পর্যায়ে নানা টুর্নামেন্ট, লিগ, প্রতিযোগিতা, নারী-পুরুষ দলের প্রশিক্ষণ আয়োজনই ৩৩ কোটি টাকা ধরেছে দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ঘরোয়া প্রতিযোগিতার মধ্যে নতুন করে আলোচনায় আসা সুপার কাপের জন্য প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ ও প্রস্তুতি খাতে ১০ কোটি ২৫ লাখ টাকা প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে। ফেডারেশনের স্টাফদের বেতন-বোনাস ও অন্যান্য ভাতার জন্য বার্ষিক ব্যয় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। ইউটিলিটি বিল, বিভিন্ন মেরামতের জন্য ১ কোটি ১৫ লাখ ধরা থাকলেও আবার আলাদা অন্যান্য খাতে বিশেষভাবে সাড়ে তিন কোটি টাকা দেখানো হয়েছে।

২০২৪ সালের অর্ধেক সময় ইতোমধ্যে শেষ। ইতোমধ্যে অনেক খরচও করেছে ফেডারেশন। বছরের অর্ধেক পেরিয়ে এখন বাজেট অনুমোদনের হুঁশ হয়েছে দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ এই সংস্থার। কাউন্সিলরদের কাছে সম্ভাব্য এক পাতার আয়-ব্যায়ের বাজেটে সভাপতি, ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান, সাধারণ সম্পাদক কারও কোনো স্বাক্ষর নেই। অনেকটা নামকাওয়াস্তের মতো কাজ!

দুই বছর দুই কোম্পানির অডিট, আয়-ব্যয়ে নানা সংশয়
আগামীকাল এজিএমে ২০২২ ও ২০২৩ সালের অডিট রিপোর্ট অনুমোদনের প্রস্তাব রয়েছে বার্ষিক সাধারণ সভার আলোচ্যসূচিতে। দুই বছরের অডিট করেছে দু’টি ভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ভিন্ন প্রতিষ্ঠান করলেও দুই অডিট রিপোর্টেই ছোটখাটো অনেক ভুল-অসঙ্গতি চোখে পড়েছে ফুটবলসংশ্লিষ্টদের। বাফুফের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ফুটবলাঙ্গনে অনেকদিন ধরেই। এখন ফিফার শাস্তির পর সেই সন্দেহ আরও বড় আকারে।

২০২২ সালে নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর অনেক প্রতিষ্ঠান বাফুফেকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে আবার সরাসরি নারীদেরও পুরস্কৃত করেছে। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর নারী ফুটবলারদের উন্নয়নে বাফুফেকে কোটি টাকা দিয়েছিল। বাফুফের এক সহ-সভাপতি তার ঘোষণাকৃত ৫০ লাখ টাকাও ফেডারেশনের ফান্ডে দিয়েছিলেন। এত বড় অঙ্কের অর্থ অবশ্যই আলাদা হিসাব/শিরোনামে আয়-ব্যয় থাকা আবশ্যক। অথচ দুই বছরের অডিট রিপোর্টের পাতা উল্টিয়েও এরকম কিছু স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়নি।

আয়ের খাতের চেয়ে ব্যয়ের খাতে প্রশ্নের জায়গা আরও বেশি। দুই বছরের অডিট রিপোর্টের নানা জায়গায় মিডিয়া এন্ড পাবলিসিটি খাতে প্রচুর ব্যয় দেখানো হয়েছে। যোগ করলে যার পরিমাণ অর্ধ কোটিরও বেশি হবে। অথচ সাংবাদিকদের লিগ ম্যাচ কাভার করতে নিজেদেরই চা-নাস্তা এনে খাওয়ার ঘটনা ঘটে প্রায়ই। এরকম আরও অনেক খাতেই নানা অসঙ্গতি ও অপূর্ণতা রয়েছে।