৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
প্রকাশিত:বুধবার, ২৯ মে ২০২৪ ০৩:০৫
নিউজ ডেস্ক: বুধবার (২৯ মে) রাজধানীর লালমাটিয়ায় পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার (এসডো) সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন তুলে ধরে। এসডো ও আইপেন-এর যৌথ গবেষণায় ঢাকা ও তার আশেপাশের শিল্প এলাকায় থেকে সংগৃহীত পৃষ্ঠ ও কলের পানির নমুনায় উচ্চ মাত্রার বিষাক্ত পিফাস রাসায়নিক পাওয়া যায়। অনেক নমুনায় পিফাসের পরিমাণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডসের নির্ধারিত মাত্রার অনেক উপরে ছিল। এর মধ্যে কিছু নমুনায় নিষিদ্ধ পিফাসের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের প্রয়োজন। জনগণের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত নিয়ন্ত্রণ সংস্থাসমূহকে পিফাস দূষণ নির্মূল ও হ্রাসের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
পিফাস কী?
পিফাস বা পার-পলিফ্লুরোঅ্যালকিল হল মানুষের তৈরি এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা এর স্থায়িত্ব এবং পানি, তেল, এবং তাপ প্রতিরোধের জন্য পরিচিত। ১৯৪০-এর দশক থেকে, পিফাস বিভিন্ন পণ্য এবং শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যেমন নন-স্টিক কুকওয়্যার, পানি- এবং দাগ-প্রতিরোধী সুতা, খাদ্য প্যাকেজিং, অগ্নিনির্বাপক ফোম, প্রসাধনী এবং অন্যান্য শিল্প ক্ষেত্রে। পানি, দাগ-প্রতিরোধ, তাপ প্রতিরোধ, এবং রাসায়নিক স্থিতিশীলতার জন্য পণ্যে পিফাসের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে।
পিফাসে স্বাস্থ্য ঝুঁকি
পিফাস পরিবেশে সহজে ভাঙে না এবং প্রাণীর শরীরে স্থায়ীভাবে জমা হতে পারে, এর ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে এই রাসায়নিক পদার্থগুলো বিভিন্ন মাধ্যম থেকে খাল-বিল, নদী-নালাতে চলে আসছে এবং আমাদের খাবার পানিতে মিশে যাচ্ছে।
পিফাসের বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে, যার মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, ভ্রূণের বৃদ্ধি এবং থাইরয়েড হরমোন কার্যকারিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘমেয়াদী পিফাসের সংস্পর্শে থাকার ফলে উচ্চ রক্তচাপ, ভারসাম্যহীনতা, কম ওজনে জন্ম এবং টিকার কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়া পিফাস লিভারের ক্ষতি করে বিভিন্ন ক্যান্সারজনিত রোগ সৃষ্টি করে।
গবেষণায় যা পাওয়া গেল
বাংলাদেশে পিফাস নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই, তাই এই গবেষণার ফলাফল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নেদারল্যান্ডস এবং যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ৩১টি পৃষ্ঠের পানির নমুনার মধ্যে ২৭টিতে পিফাস পাওয়া গেছে।
১৮টি নমুনায়, স্টকহোম কনভেনশনের অধীনে বিশ্বব্যাপী নির্মূলের জন্য তালিকাভুক্ত পিফাস শনাক্ত করা হরেছিল। ১৯টি নমুনায়, ভূ-পৃষ্ঠের পানির জন্য প্রস্তাবিত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি পিফাস শনাক্ত করা হয়েছিল। বেশ কয়েকটি নমুনায় বেশি পরিমাণে পিফাস পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে ট্যাপের পানির নমুনাগুলোতেও খাবার পানিতে পিফাস পাওয়া গেছে। চারটি নমুনার মধ্যে তিনটিতে পিফাস রয়েছে। তিনটি পিফাসযুক্ত নমুনা ইউএস পিএফএ থ্রেশহোল্ডের উপর পরীক্ষা করা হয়েছে এবং একটি ইইউ নির্ধারিত সীমার বেশি পিফাস পরীক্ষা করা হয়েছে।
পানির নমুনাগুলো বনানী, টঙ্গী এবং পোশাক শিল্প কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকাগুলো থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল এবং অন্যান্য উৎপাদন শিল্প যেমন- পোশাক, ট্যানারি, ইলেকট্রনিক্স, রাসায়নিক, ফার্মাসিউটিক্যাল অথবা স্টিল প্ল্যান্ট ছিল।
২০১৯ সালে কর্ণফুলী নদীর পানিতে সর্বোচ্চ পিফাস শনাক্ত করা হয়েছিল, যা প্রস্তাবিত ইউরোপীয় সীমার চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি। সেই নমুনায় দুটি নিষিদ্ধ পিফাসেরও উপস্থিতি ছিল, যা বর্তমান ডাচ সীমার চেয়ে ১ হাজার ৭০০ গুণ বেশি এবং ৫৪ হাজার ০০০ গুণ বেশি। ২০২২ সালে হাতিরঝিল লেক থেকে নেওয়া হয় যাতে পিফাস পিএফওএ এবং পিএফওএস উপস্থিত ছিল, যা ডাচ সীমার চেয়ে ১৮৫ গুণ বেশি ছিল। উচ্চ পিফাস পাওয়া গেছে এমন নমুনাগুলো পোশাক শিল্প কারখানার কাছাকাছি এলাকায় বেশি পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে যে পোশাক শিল্পে পাওয়া পিফাস পানি দূষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে।
২০২২ সালে দুটি জলপথে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ঢাকা এবং আদমজী ইপিজেড) কাছাকাছি আপস্ট্রিম ও ডাউনস্ট্রিমের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, যেখানে ডাউন্সট্রিমের নমুনাতে উঁচু পিফাস ঘনত্ব পাওয়া যায়। গবেষণাটিতে বাংলাদেশের পোশাকও পরীক্ষা করা হয়েছে। পাঁচটি স্যাম্পল পোশাকের সবকটিতেই পিফাস পাওয়া গেছে এবং একটি পুরুষের জ্যাকেটে নিষিদ্ধ রাসায়নিক পিএফওএ পাওয়া গেছে।
করণীয় কী?
পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার (এসডো) সিনিয়র পলিসি ও টেকনিক্যাল উপদেষ্টা এবং গবেষণা দলের প্রধান ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, এ গবেষণায় আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ও পানিতে পিফাসের উপস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশের ওপর পিফাস-এর স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি কমানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সুপারিশ প্রদান করা।
তিনি বলেন, পিফাস দ্বারা দূষিত পণ্যগুলোকে পুনঃব্যবহারযোগ্য নয় এবং অ-চক্রাকার হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে। পিফাস-যুক্ত ভোক্তা পণ্য যেমন টেক্সটাইল, টেক্সটাইল পণ্য এবং খেলনা, রান্নার সামগ্রী, খাদ্য প্যাকেজিং এবং অন্যান্য পণ্যের ব্যবহারসহ উৎপাদন ও আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। পিফাস বা টেক্সটাইল উৎপাদনে ব্যবহৃত জায়গার আশেপাশের স্থানের মাটি এবং খাবার পানির বিশুদ্ধ করতে দ্রুত এবং দক্ষ পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার (এসডো) নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, আন্তর্জাতিক পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু এই খাত থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক নির্গমন জনগণকে উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলছে। আমাদের নদী-নালা ও কলের পানিতে পিফাস দূষণ ঘটছে। এ কারণে রপ্তানি শিল্প কারখানাগুলোকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। তাদের বাজার বিশ্বব্যাপী হতে পারে, কিন্তু দূষণ স্থানীয় পর্যায়ে বেশি হচ্ছে। স্টকহোম কনভেনশনের সদস্য হিসেবে, বাংলাদেশকে পিফাস নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক মান বাস্তবায়ন করা জরুরি।
সম্পাদক ও প্রকাশক: এম. দেলোয়ার হোসেন
অফিস: অফিস: রোম নং-৫, নীচতলা, ১৭-১৮, বাইন কোর্ট, হোয়াইটচ্যাপল, লন্ডন।
মোবাইল: ০৭৩৭৭-৯৫১৬৮১