গ্রামীণ সাহিত্যের একনিষ্ঠ সংগ্রাহক

প্রকাশিত:বৃহস্পতিবার, ৩০ মে ২০২৪ ১১:০৫

গ্রামীণ সাহিত্যের একনিষ্ঠ সংগ্রাহক

নিউজ ডেস্ক: আশির দশকেও গ্রামের সংস্কৃতিমনা মানুষের বাড়ির আঙিনায় রাত নামলেই পুঁথিপাঠ ও হাটুরে কবিতার আসর বসতো। চলত কেচ্ছাধর্মী গান। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার মালতীনগর গ্রামের আবু বক্কার তালুকদারের বাড়িও তার একটি। কিশোর বয়সে এসব আসরের সঙ্গে পরিচয় হয় আবু বক্কারের ছেলে আবদুল গণি তালুকদারের। পুথিঁ, হাটুরে কবিতায় ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়ে তাঁর। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করেন হারিয়ে যাওয়া পুঁথি সংগ্রহের কাজ।

আবদুল গণি তালুকদারের বয়স এখন ৪৯ বছর। সারা দেশ থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন ২০টি পুঁথি, ৪৫টি সায়েরি কবিতা, শতাধিক গ্রামীণ হাটুরে কবিতা, ৬০টি হারানো দিনের গল্প, ৩০টি এলাকার কিংবদন্তি ও ৮০টি ধুয়া গান। পাশাপাশি তিনি নিজে তিন শতাধিক গান রচনা ও সুর করেছেন। যা গেয়েছেন স্থানীয় বাউলসহ বিভিন্ন শিল্পীরা।

রায়গঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ধুবিল ইউনিয়নের মালতীনগর বাজার। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে একটু এগিয়ে গেলে আবদুল গণি তালুকদারের বাড়ি। সেখানে বসে তিনি মনের আনন্দে গান ও কবিতা লেখেন। পরিচিতজনেরা তাকে হারিয়ে যেতে বসা পুঁথি, সায়েরি কবিতা, এলাকার কিংবদন্তি ও ধুয়া গানের একনিষ্ঠ পাঠক ও সংগ্রাহক হিসেবে চেনেন। এসব বিষয় নিয়ে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন সাতটি। বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে নিবন্ধনও করেছেন সেসব। কিন্তু নানা কারণে এসব পাণ্ডুলিপি প্রকাশ না পাওয়ার আক্ষেপে দিন কাটছে তাঁর।

আবদুল গণি তালুকদারের গ্রামীণ সাহিত্যের এ সাধনাকে উৎসাহিত ও সম্মানিত করতে বাংলাদেশ ফোকলোর গবেষণা কেন্দ্র ২০১৭ সালে তাকে ঐতিহ্য সম্মাননা প্রদান করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, গ্রামের হাটুরে কবিতা, পুঁথি, সায়েরি সংগ্রহ করে তা পাণ্ডুলিপি আকারে তৈরি করা ও কপিরাইট নিবন্ধন পাওয়া অনেক সাধনার কাজ। আবদুল গণি তালুকদার সেসব কাজ করেছেন। এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করতে পারলে বিদেশি ভাষায় বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা গেলে বিশাল একটা কাজ হবে। এটি বাংলা ভাষায় গ্রামীণ সংস্কৃতির নতুন দিক তুলে ধরবে।

তিন ভাই ও এক বোনের মধ্য আবদুল গণি তালুকদার তৃতীয়। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন তিনি। উপজেলার সলঙ্গা ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও সলঙ্গা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) করেন।

আবদুল গণি তালুকদার বলেন, আমার নানার গোলেয়ারজান নামের একটি যাত্রাপালার দল ছিল। এ নামে নানা একটি যাত্রাপালাও রচনা করেন। ছোটবেলায় নানার মুখে এ যাত্রাপালা শুনে শুনে লিখে রাখতেন। নানার আগ্রহে শুরু করা এ কাজ তাঁর নেশায় পরিণত হয়।

১৯৯৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আবদুল গণির বাবা মারা যান। বাবার রেখে যাওয়া জমিতে লাঙল, জোয়াল আর হালের গরু নিয়ে কৃষিকাজ শুরু করেন। এ সময় বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। মাটির মানুষের হৃদয়ের সহজাত ভালো লাগা গ্রামীণ বিনোদনের পুঁথিপাঠ, গ্রাম্য কবিদের হাটুরে কবিতা পাঠের আসরে হাজির হতেন তিনি। এরই মধ্যে একদিন বাবার বাক্স খুলে দেখতে পান গ্রামীণ সাহিত্যকর্মের বেশকিছু সংগ্রহ। তবে বেশিরভাগই ছিঁড়ে গেছে অথবা পোকায় কেটেছে। তখন আবদুল গণি গ্রামীণ মানুষের বিনোদনের উৎসগুলো বই আকারে প্রকাশের চিন্তা করেন।

২০০৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদের সচিব পদে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। এতে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফেরায় গ্রামীণ সাহিত্যের হারিয়ে যাওয়া পুঁথি ও হাটুরে কবিতার খোঁজে সময় দিতে লাগলেন। তবে সেই কাজও সহজ ছিল না। আবদুল গণি বলেন, ২০১৪ সালে উল্লাপাড়া উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদে কর্মরত অবস্থায় ইউপি সদস্য আবদুল জব্বার মিঞা তাঁ হাতে বেশ কয়েকটি হাটুরে কবিতা তুলে দেন। উপজেলার আরেক গ্রামে এক গ্রামীণ কবির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁর ছেলেদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল। তবে ওই কবি লুকিয়ে তাকে তাঁর লেখা একটি হাটুরে কবিতা উপহার দিয়েছিলেন। আবদুল গণি তালুকদারের এমন কাজের প্রশংসা করে সংগ্রহ কাজের অনুমতি নিয়ে দিয়েছিলেন জেলার তৎকালীন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক তন্ময় দাশ।

উপজেলার ধুবিল ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মো. হাসান ইমাম তালুকদার বলেন, ইউপি সচিবের দায়িত্ব পালন করে নিজের মনের আনন্দে গণি তালুকদার এসব কাজ করেছেন। এখনো করে যাচ্ছেন। তার এ কাজ অব্যাহত থাকলে এলাকার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে বলে আশাবাদী তিনি।

আবদুল গণির সংগ্রহ ও নিজের লেখা গান নিয়ে পাণ্ডুলিপি তৈরি করা হয়েছে সাতটি। সেগুলো হলো- আমার গান, স্মৃতির অন্তরালে গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষের আনন্দ বিনোদনের উৎস, হারানো দিনের হালখাতা, জাতীয় বোধের অস্তিত্বে জাতীয় চার নেতা, হারানো মানিকের একটুখানি, গ্রামীণ কবিয়ালগণের কাছে আওয়ামী রাজনীতির ঋণ ও সায়েরি কবিতার ইতিকথা। প্রতিটি পাণ্ডুলিপি বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস থেকে নিবন্ধন করেছেন তিনি। এ কারণে ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর কপিরাইটস অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী তাঁকে প্রশংসাপত্র দেন।

ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন বিষয়ে পড়ালেখার আগ্রহের কথা উল্লেখ করে আবদুল গণি তালুকদার বলেন, সলঙ্গা ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক প্রয়াত আবদুস সালামের সংগ্রহে থাকা ইংরেজি সাহিত্যের বইসহ বেশির ভাগ বইপত্র পড়া শেষ করেছিলেন স্কুলজীবনে। এ নিয়ে বাবার সমর্থন ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাবা চাইতেন জীবনে ভালো কিছু যেন করতে পারি।’

আবদুল গণি তালুকদারের লেখা ও সুর করা বেশ কয়েকটি গান গেয়েছেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত লোকগীতি শিল্পী অবিনাশ বাউল। তিনি বলেন, গণি তালুকদারের লেখা গান খুবই ভালো মানের রচনা। শ্রোতারা তাঁর গান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুনে থাকেন।

স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে আবদুল গণির সংসার। বড় ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছোটছেলে সাড়ে চার বছরের। পাণ্ডুলিপিগুলো প্রকাশ না করতে পারার দুঃখবোধের কথা উল্লেখ করে আবদুল গণি তালুকদার বলেন, ‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এসব প্রকাশ করার চেষ্টা করে যাবো। কেউ পাশে এসে দাঁড়ালে তাঁর প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবো।’

জেলা কালচারাল অফিসার মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, গ্রামীণ সাহিত্যের একটা ভাণ্ডার গড়ে তুলেছেন লেখক ও গবেষক আবদুল গণি তালুকদার। তাঁর এসব কীর্তি প্রকাশ করার জন্য সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।